Quantcast
Channel: Soliloquy of a Wandering Pilgrim
Viewing all 89 articles
Browse latest View live

Brejiler Bicchu

$
0
0
ব্রেজিলের বিচ্ছু

হুয়ারাজের সেই সেভিচেরিয়া , ছবিঃ লেখক

২০১৮। আন্দিজ পর্বতমালার যে অংশ পড়েছে পেরুর ভাগ্যে, সেই পাহাড় শ্রেণীর নাম ‘কোর্দিয়েরা ব্লাঙ্কা’। সেখানে যেমন রয়েছে অপূর্ব সুন্দর কিছু শৃঙ্গ, তেমনই রয়েছে পর্বতারোহনের অন্যতম দূর্গম কয়েকটি চ্যালেঞ্জ। ইতালিয়ান অ্যাল্পাইন ক্লাবের আমন্ত্রণে, কোর্দিয়েরা ব্লাঙ্কা-র কঠিনতম ‘উয়ানসান’ শৃঙ্গে অভিযান শেষে আমি একলা পথ ধরেছিলাম। প্রায় একমাস ধরে, আমরা কয়েকজন পর্বতারোহী, উয়ানসানকে ক্লাইম্ব করার লক্ষ্যে স্থির থেকে লড়াই চালানোর পর বুঝতে পেরেছিলাম কেন তাকে ‘আন্দিজের কে-টু’ বলা হয়। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে দাঁড়াতে না পারার কোন আক্ষেপ ছিল না। বরং ছিল, এক স্বাবলম্বী ক্লাইম্বের বিশুদ্ধ আনন্দ। বেসক্যাম্পে আমার ইতালিয় এবং কেচুয়া বন্ধুদের বিদায় জানিয়ে, পিঠে নিজের রুকস্যাক তুলে হাঁটা দিয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, হাতে যেটুকু সময় বেঁচে ছিল তা কাজে লাগিয়ে পেরু দেশটাকে একটু দেখে নেওয়া। 

উয়ানসান বেস ক্যাম্প থেকে ফেরার পথে কেচুয়া ঠাম্মা। দেশ দেখা শুরু। তার আগে অবধি পাহাড় চড়া চলছিল। 


প্রথমে একটা লম্বা হাঁটা, তারপর কিছুটা হিচ-হাইক করে দিনের শেষে পৌঁছে গিয়েছিলাম অপূর্ব সুন্দর শহর হুয়ারাজ। সন্ধ্যায় হাঁটতে বেরিয়ে এক সেভিচেরিয়ায় আলাপ হয়েছিল মায়া এবং সিসকোর সঙ্গে। পাহাড়তলিরশহর হুয়ারাজের ব্যস্ত এই রেস্তোরাঁয় এই দুজনের মুখ একেবারে অন্যরকম মনে হয়েছিল। স্থানীয় কেচুয়াদের মত একেবারেই দেখতে ছিল না তারা, উল্টে অনেকটা যেন আমাদের গ্রাম বাংলার কোন নদীর পাড়ের মানুষ মনে হয়েছিল তাদের। মজার ব্যাপার হল, একই ঘটনা ঘটেছিল মায়া এবং সিসকোর সঙ্গেও। ওরাও বেশ অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। কয়েক মুহুর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে উঠে সিসকোই আমার দিকে আলাপের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমার বাড়ি ভারতেশুনেই একরকম লাফিয়ে উঠেছিল দুজনে।ওদের উত্তেজনা দেখে আমার অবাক লেগেছিল। মায়া বলেছিল, বরফের মধ্যে থেকে পুড়ে গেছ। এবার আমাদের সঙ্গে চল। বলেছিল, আমাদের বাড়িটা আসলে একটা ভেলা। হ্যাঁ, ঠিকই শুনছ, নদীর ওপরই শোবে, স্নান করতে ইচ্ছে হলে সটান জলে ডাইভ দেবে, আর খিদে পেলে জাল ফেলব- কতরকম যে মাছ ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। মাছ খাও তো?

হুয়ারাজের মাছের বাজার

আমি একরকম হাঁ করেই ওদের কথা শুনছিলাম। ওরা নিজেদের পেরুরই বাসিন্দা বলছে, আবার এরকম এক নদীর জীবনের গল্প শোনাচ্ছে- ব্যাপারটা কি? আন্দিজ পাহাড়, চাভিন, মোচে, ইনকা সভ্যতা, নাজকা লাইনস, মাচু-পিচু, কন-টিকি অভিযান, পনচো পরা কেচুয়া মানুষের গ্রাম- এই সব এতদিন পর্যন্ত মনের ক্যানভাসে কোলাজ হয়ে ছিলকিন্তু, এ আবার কী বলছে? তাই জিগ্যেস করেই ফেলি, পেরুতে এরকম জায়গা আছে নাকি? আমার মৃদু অবিশ্বাস দেখে এবার সিসকো বলে, আছে মানে? আমাদের বাড়ি ইকিতোস, অ্যামাজন নদীর ধারে। লিমা থেকে কোন গাড়ির রাস্তা নেই ওখানে পৌঁছনোর। একমাত্র পথ উড়োজাহাজ। ইকিতোস-কে তুমি দ্বীপও বলতে পার, আবার শহরও বলতে পার, বলেই হাহা করে হেসে উঠেছিল সিসকো। 

মায়া এবং সিসকোর সঙ্গে লেখক 
অ্যা-মা-জ-ন, বিস্ফারিত আমার চোখ, সে তো স্বপ্নের মত এক ব্যাপার! বল কি? তোমরা অ্যামাজনের মানুষ! এক নিশ্বাসে বলেছিলাম আমি। আমার উত্তেজনা দেখে এবার কেবলই মুচকি হেসেছিল মায়া এবং সিসকো। আর বলেছিল, ভেবে দ্যাখো, যাবে কি না? এখনও সময় আছে। সেরকম হলে, আগামীকাল আমাদের সঙ্গে তোমারও একটা টিকিট কেটে নেব। বেসক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুহূর্ত থেকে আমার মাথায় জেদ চেপেছিল যে, লেক টিটিকাকা এ যাত্রায় দেখবই। তাই হুয়ারাজের সেই সন্ধ্যায়, অ্যামাজন থেকে আসা এক অযাচিত আমন্ত্রণকে মুলতুবি রেখেছিলাম। বলেছিলাম, যদি আবার কখনও আসি দক্ষিণ আমেরিকা, তবে একমাত্র অ্যামাজনের জন্যেই আসব। তখন তোমাদের ভেলাতে থাকতে দেবে তো? অবশ্যই, সমস্বরে সম্মতি জানিয়েছিল আমার নতুন দুই বন্ধু। ইতিমধ্যে, টেবিলে জড়ো হয়েছিল পেরুর বিখ্যাত বিয়ার কুজকেনা, সঙ্গে কাঁচা মাছ আর অক্টোপাসের সেভিচে।

দূরে লেক টিটিকাকা

২০১৯। মায়া এবং সিসকোর সঙ্গে শেষবার কথা হয়েছিল ২০১৮র বড়দিনের সময়। কয়েকদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপে হঠাৎ মায়ার মেসেজ এল। কোমো এসতাস, অর্থাৎ, কেমন আছ ইত্যাদির পরই কথা উঠল আগুনের। মায়া লিখল, মালোগ্রামোস তোদো, আমরা সব কিছু ধ্বংস করে দিচ্ছি। এত লজ্জা রাখব কোথায়? আমার জবাব দেবার কিছুই ছিল না। ব্রেজিলের বিচ্ছু এবার বাস্তবে দেখা দিয়েছে এবং বিপদ কেবল সেখানেই থেমে নেই। একই ধরনের লোভী এবং সর্বগ্রাসী নেতা বিশ্বের সব প্রান্তেই মাথা চাড়া দিচ্ছে। পৃথিবীর অরণ্য ধ্বংসের উৎসবে রাশিয়া, পোল্যান্ড, মেক্সিকো, পাপুয়া নিউ গিনি, সুদান, নাইজেরিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত- কেউ থেমে নেই। এই মুহুর্তে অ্যামাজনে, দাবানল নয়, মানুষ আগুন লাগাচ্ছে। সরকার নেভাতে চাইছে না। অ্যামাজনের কথা বাদ দিলে, অরণ্য ধ্বংসের মহোৎসবে যেখানে আগুন লাগানো হচ্ছে না, সেখানে অন্য পদ্ধতি নেওয়া হচ্ছে। বনবাসী-আদিবাসীদের উচ্ছেদ সেইসব জায়গায় তাদের প্রথম পদক্ষেপ। মধ্য আফ্রিকায় পিগমি বাটোয়া, পূর্ব আফ্রিকায় মাসাইদের মত, এই ভারতেও ১০ লক্ষের বেশী বনবাসীর উচ্ছেদ পরোয়ানা জারী হয়ে গেছে। মানুষের মৌলিক চাহিদাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে বানিজ্যিক লোভ। অ্যামাজনের বৃষ্টিবন তাই আমাদের কিছুই বলতে চাইছে না। কারণ, বৃষ্টিবনেরা কখনই কিছু বলে না। কারণ, তারা জ্বলছে না, তাদের জ্বালানো হচ্ছে। আজ তাই মনে হচ্ছে, হুয়ারাজের সেই সন্ধ্যায়, অ্যামাজনের আমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়াটা সম্ভবত খুব ভুল হয়ে গিয়েছিল। 

Image Courtesy: Wall Street Journal 




Lockdown Soliloquies-1

$
0
0
লকডাউন স্বগতোক্তি - ১

কালাহারি বুশম্যান শিশু। নেট থেকে পাওয়া ছবি। আমার তোলা নয়। 
লকডাউনের বাজারে, দিন কয়েক আগে, হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ পেলাম। ব্যক্তব্য, ‘এই দূর্দিনে শেরপারা বড় কষ্টে আছেন। তাঁদের সব অভিযানের কাজ আপাতত মুলতুবি হয়ে গেছে। আমরা কি তাঁদের জন্য কিছু সাহায্য যোগাড় করে দিতে পারিনা?’ 

ব্যক্তব্যের সঙ্গে আমি সম্পুর্ণ একমত হয়েও কিছু জবাব দিতে পারিনি আজও। কারণ, আমার নামের পিছনে শেরপা কিংবা কোনও পাহাড়ি পদবী না থাকলেও, কাজটা আমি একই করিহিমালয়ে অভিযানে গিয়ে শেরপারা যা করে থাকেন, ঠিক তাই।গত বিশ বছর ধরে করি। এ বছরের সব কাজ আমারও চলে গেছে। অন্তত এই মুহুর্তে তাই মনে হচ্ছে। 

তবে, সত্যি কথা বলতে কি, কিছুটা দুশ্চিন্তা হলেও, নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে না। কারণ, আমি জানি, আমি ভারতবর্ষ, তদোপরি বাঙালিস্তানে জন্মেছি। প্রফেশনাল অ্যাডভেঞ্চারিস্টরা এখানে জন্মানোর আগেই মারা যান। কিন্তু, আমি তো মারা যাই নি। গত দু দশক ধরে, স্বতন্ত্র, স্বাবলম্বী ভাবে ওরিজিনাল কিছু অ্যাডভেঞ্চার করেছি এবং আগামী দিনেও কিছু করে যাব।  আমার নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মুখুজ্যে বামুন ইত্যাদি ব্যাপার স্যাপার আমার চিরকালই বেশ জঘন্য মনে হত। মনে হত এর থেকে কালাহারির বুশম্যান কিংবা সাহারার তুয়ারেগ হওয়া ঢের ভাল ছিল। 

তবে, এই পোস্ট দেখে আমার একটা পুরনো বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল। সেটি হল,  বাঙালি ছিঁচকাঁদুনে ছাড়া আর বেশী কিছু কোনদিনই ছিলনা, আজও নেই। তাই জন্যই বাঙালির পর্বতারোহণ আসলে একটি সোনার পাথর বাটি। শেরপাদের তাঁরা যে আসলে কী চোখে দেখেন এবং অভিযানে কী ভুমিকায় ব্যবহার করেন সেটা আমার জানা আছে।  তাই, এটাও জানি যে, শেরপারাও বাঁচবেন, বাঙালির কুম্ভীরাশ্রু ব্যতিরেকেই বাঁচবেন।  

তাই এমনিই লিখলাম, সলিলোকি আফটার অল। আপনারা সিমপ্যাথি কার্ড খেলতে থাকুন। পরিস্থিতি বেশ জমে উঠেছে। আর আমার জন্য ভাববেন না, ভাবার ভান করবেন না, আহা উহু করবেন না। 

জীবনের স্লগ ওভার শুরু হয়েছে। চালিয়ে খেলব এমনিতেই।   এফ ইউ।  



পিএস- মুফাসার ছবি চুরি করবেন না। এটা আমার তোলা। চুরি করলে ঠাকুর পাপ দেবেন। 

Lockdown Soliloquy-2

$
0
0

লকডাউন স্বগতোক্তি-২


আমার এক দাদার কাছে শুনেছিলাম, ‘অ্যালগরিদম’ ব্যাপারটাকে রপ্ত করে ফেলার মধ্যেই নাকি আজকাল লুকিয়ে থাকে কোম্পানি গুলোর বাণিজ্যিক সাফল্য। দাদা আরও বলেছিলেন, অ্যালগরিদম ঠিকঠাক বিশ্লেষণ করে ফেলতে পারলে মানব সভ্যতার বড় বড় সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমার কানে দাদার সেই বাণী ছিল একরকম ভস্মে ঘি ঢালার সমান। আমার মত এক সামাজিক অর্বাচীন, যার কাছে ‘মানব’ এবং ‘সভ্যতা’ হল বিপরীতার্থক শব্দ, তার কাছে এসব জীবনমুখী কথা বলার কোনও মানে হয় বলুন তো?


এদিকে হয়েছে কি, সম্ভবত, এই অ্যালগরিদমের কারনেই, ফেসবুকে আমার ‘লাইক’ দেওয়া বিদেশী অ্যাডভেঞ্চার এবং ক্লাইম্বিং চ্যানেলগুলো অবিরাম আমাকে দেখিয়ে চলেছে, প্রত্যহ কিসব কাণ্ডটাই না করছেন তাঁদের দেশের এলিট ক্লাইম্বাররা। দেখতে পাচ্ছি, লকডাউন তাঁদের ক্লাইম্বিং স্পিরিটকে দাবায়ে রাখতে একেবারেই অক্ষম। দেখতে পাচ্ছি, কেউ তাঁদের কিচেনের টেবিল-চেয়ার ক্লাইম্ব করছেন, কেউ ফ্ল্যাটের দেওয়াল বেয়ে চিমনি করছেন, কেউ সিঁড়ি দিয়ে এতবার ওঠানামা করছেন যে মাউন্ট এভারেস্ট চড়া হয়ে যাচ্ছে! আর সেই না দেখে ইন্টারনেট জুড়ে পাবলিকের সেকি আহ্লাদের ফোয়ারা! পুরো সুকুমারোচিত স্টাইলে ‘দেখ বাবাজী দেখবি নাকি দেখ রে খেলা দেখ চালাকি’ ইনফাইনাইট লুপে চলছে। 



বুঝুন কারবার! এদিকে আমাদের দেশের মাউন্টেন ক্লাইম্বাররা ভাবছেন জুন মাস থেকে খাবেন কি? ইন্টারনেটে পোস্ট দেবার জন্য ব্যায়ামাদি করলে তো আবার খিদে বেড়ে যাবে। তখন, তাঁরা খাবার পাবেন কোথায়? তাঁদের ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজ যাবেন কী করে? শেষে কি ধার-দেনা করতে হবে? তবে, আশার কথা এই যে, একগাদা ‘বসন্ত এসে গেছে’-টাইপ ফুরফুরে হবিইস্ট বাদ দিলে, এদেশে ফুল-টাইম মাউন্টেনিয়ার, অ্যাদ্ভেঞ্চারার নাই বললেই চলে। তাই সেরকম দুয়েকজন অর্বাচীন এসকেপিস্ট না খেয়ে মরলে কাকপক্ষীও টের পাবেনা।


তাই, বুঝলেন, আজকাল মন পারপেচুয়ালি খারাপ থাকে। খারাপ বলতে একেবারে হাউহাউ করে কাঁদার মত, কিংবা, বাড়ির ছাত থেকে ঝাঁপ দেবার মত নয়। কেবল একটা অবসন্ন হতাশা কাজ করে চলে। তবু হাল ছাড়া যায় না। কারণ এমন হতাশা আজ চারদিকে, সমস্যা কারও একার নয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, সামুহিক হতাশাও কি একটা সলিডারিটি আনতে পারে? মানুষকে যুক্তিবাদী, ইতিহাস সচেতন, বিজ্ঞানমনস্ক, দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে?  


ধুস, পারে হয়ত, তবে সে অন্য কোথাও, এ দেশে নয়। আপনি যদি ভারতবাসী হন এবং আপনার যদি এই আশা জন্মায় যে এই বিষাদের সংহতি আগামী দিনে কোনও বিপ্লবের জন্ম দিতে চলেছে, সমাজকে বদলে দিতে চলেছে, তাহলে আপনি নির্ঘাৎ দিবাস্বপ্ন দেখছেন, অথবা, আপনার পেট গরম হয়েছে। ভারতবর্ষে আর যাই হোক, কোনও গণ অভ্যুত্থান, কোনও বিপ্লব হবে না। হতে পারে না। আমরা জাত-পাত, পুরুষ-নারী, হিন্দু-মুসলিম নিয়ে থাকব, শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত থাকব। ইতিহাস কখনও মিথ্যে বলে না।


অবশ্য দাদাগো, লোতুন করে ইতিহাস বই লিখলে, মিখ্যাকেও সত্য বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়। এতো আকছার হচ্ছে। ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল- মনে নেই? 

    
এই বলে চোখ টিপলুম এবং আজকের মত স্বগতোক্তি শেষ করলুম।       

Photo courtesy : CNN

দেখ বাবাজী দেখবি নাকি


Ganga Theke Chinsha- A PDF Book in Bengali

$
0
0

গঙ্গা থেকে চিনশা- অবশেষে একটি পিডিফ বই 



২০১৫ সালে চীনের ইউনান প্রদেশে গিয়ে চিনশা নদীর দ্বিতীয় ১৮০ ডিগ্রীর বাঁকে লুকিয়ে থাকা এক পর্বতমালার খোঁজ নিয়ে একসময় যে লেখালিখি করেছিলাম সেটাকে একজোট করে একটা পিডিএফ বইয়ের আকার দেওয়া হল অবশেষে। অনেক ছবি এবং ম্যাপ সহযোগে এই বই ডিজাইন করেছেন সৌরভ নন্দী। বইটির আত্মপ্রকাশের নেপথ্যে রয়েছেন অভিজিৎ সুকুল এবং ইয়েতি অ্যাডভেঞ্চার্স।   দাম মাত্র ১০০ টাকা। নীচের লিংকে গিয়ে বইটি প্রি-অর্ডার করা যাবে। এখন প্রি-অর্ডার করলে আগামী ১ আগস্ট, ২০২০, সকলকে বইটি ইমেল করে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

বইটি প্রি-অর্ডার করার লিংক

খিক খিক এবং দীর্ঘশ্বাস

$
0
0



প্রয়োজন পড়লে নিজেকে আবিষ্কার এবং পুনরাবিষ্কার করতে হয় এমন কথা একজন কবি লিখেছিলেন। লেখার সময় কবি আকণ্ঠ রেড ওয়াইন পান করেছিলেন সম্ভবত। বেশীর ভাগ কবিতা পাঠের আসরে ওনাকে সেভাবেই দেখা যেত। তাই বলি, বেশ করেছিলেন। ঠিক করেছিলেন। ওনার রেড ওয়াইন উনি গিলেছিলেন। কিন্তু আবিষ্কার পুনরাবিষ্কার ইত্যাদি বিএস না লিখলেই পারতেন। কারণ, সেই কবে থেকে আমিও আবিষ্কার-পুনরাবিষ্কারের খেলা খেলছি। রেড ওয়াইন ছাড়াই খেলছি। তবু হিসেব মিলছে না। তাহলে কি আমার কাছে রেড ওয়াইন নেই বলেই মিলছে না?  খিক খিক এবং দীর্ঘশ্বাস। 



বিকাশের অসুখ

$
0
0



বিকাশের অসুখ 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

 ২০১৩। সম্ভবত জুন কিংবা জুলাই। তারিখটা সঠিক মনে পড়ছে না এই মুহুর্তে। আসলে হয়ত মনে করার জন্য প্রয়োজনীয় পরিশ্রমটুকুও করতে রাজি নই আমি আজ। দিন, মাস, কিংবা তারিখে কিই বা আসে যায়? বিশেষত, যখন সেই দিন আমি এবং আমার সঙ্গীরা কেউই মারা যাই নি। বহাল তবিয়তে দিব্যি বেঁচে আছি আজও। মারা গেলে অবশ্য, সেই দিন, মাস, কিংবা বছর; কিছু মানুষের কাছে মন খারাপের বিষয় হয়ে উঠত। কয়েক বছরের জন্য হলেও, হত। শোক সাময়িক, উচ্ছ্বাস তাৎক্ষণিক, এবং আনন্দ চিরন্তন। তবে স্মৃতি সিলেক্টিভ অ্যামনেসিয়ায় ভোগে। পছন্দের জিনিষ ঠিক মনে থাকে। বাকি সব কিছু, কিছু দিনের। তাই ইতিহাস পড়া হয়। শেখা হয় না। এই আমাদের রক্তশূন্য সভ্যতা। প্রতিদিন ঘুম ভাঙে মিথ্যা এবং প্রবঞ্চনায়। চোখ বুজি স্তোকবাক্যে। সভ্যতার গল্পে আজকাল বিশ্বাস হয় না আর।

যাই হোক, সেই বছর উত্তরাখণ্ডে ক্লাউড বার্স্ট হয়েছিল। ‘ক্লাউড বার্স্ট’-ঘন কালো বিদ্যুৎ চমকানো মেঘের মত একটা নাম। বার্স্ট, অর্থাৎ, বিস্ফোরণ। বাংলা ভাষায় কেউ মেঘ ফেটেছে না বললেও, হিন্দিতে ‘বাদল ফাট গয়া’, বলা হয়। যেকোনো বিস্ফোরণের মধ্যেই, তা সে টেররিস্টের হোক, কিংবা প্রকৃতির; একটা চমক থাকে। মানুষকে হতবাক করে দেবার ক্ষমতা থাকে। ক্লাউড বার্স্ট সেরকমই এক জিহাদ, প্রকৃতির মৌলবাদ। তো, সেই বিস্ফোরণের সময়, আমরা কয়েকজন আটকে পড়েছিলাম ত্রিশূল পাহাড়ের ওয়েস্ট ফেসের একেবারে পায়ের তলায়। নেহাতই ঘটনাচক্রে। ‘ওয়েস্ট ফেস’ কথাটা এখন লিখতে গিয়ে মনে হল, আমরা যাকে পাথর কিংবা বরফের দেওয়াল দেখি; সাহেবরা সেখানে মুখ দেখতে পায়। আর মুখ থাকলেই তার একটা পরিচয় থাকে, চরিত্র থাকে। তখন, অচেনা হলেও তার দিকে হাত বাড়িয়ে ‘হ্যালো’ বলা যায়। আমাদের ক্লাইম্বিং যেখানে দুরূহ দেওয়াল দেখে থমকে যায়, ওরা সেখানে মুখের অবয়ব খুঁজে পায়। সম্ভবত, এই প্রাণসন্ধানী মানসিকতাই ওদের ক্লাইম্বিং এর কাজটা সহজ করে দেয়। আমরা হাঁ করে পাঁচিলের নীচে দাঁড়িয়ে থাকি। দড়িদড়া বেঁধে যুদ্ধ জয়ের মহড়া দিই। ওদের আলাপ সখ্যতায় গড়ায়। 

দেওয়ালের মুখ দেখব, এই সঙ্কল্প নিয়েই সেবার কজন গিয়েছিলাম ত্রিশূল। কিন্তু, মেঘ ফাটবে, প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে; এমন সম্ভাবনা দুঃস্বপ্নেও কারো মাথায় আসেনি। বর্ষা বলে কয়ে আসে। মেঘ নোটিস দিয়ে ফাটে না। এই আকস্মিক চরিত্রের জন্যই সে বিস্ফোরণ, দহন নয়। তিনদিন, একটানা বৃষ্টি পড়েছিল। আমরা অবাক হয়েছিলাম এত উচ্চতায় বৃষ্টির ফোঁটার আয়তন দেখে। আমাদের মধ্যে কেউ কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছিল, গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বৃষ্টি পড়া বন্ধ হতে না হতেই, বরফ পড়া আরম্ভ। এতদিনে আমাদের সবকটা তাঁবুই অল্পবিস্তর ছিঁড়ে গিয়েছিল। এবার তাজা বরফের ভারে তারা আমাদের গায়ে নুয়ে পড়তে লাগল। খাবার সদ্য শেষ হয়েছিল। কেরোসিন ছিল, তাই স্টোভ জ্বলছিল। ডেকচিতে চাপান বরফ গলছিল। আমাদের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল না। তবু, শরীরের ক্ষমতা, একটু একটু করে ফুরিয়ে আসাটা বেশ জানান দিচ্ছিল। মগজের একটা দিক বলছিল, এভাবেই বরফ চাপা পড়ে এবার মারা যাব আমরা সকলে। মগজের অন্য একটা দিক অঙ্ক কষছিল, বাঁচার অঙ্ক। ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠা; শরীরের এই দুটো কাজই বেশ দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। ঘুমিয়ে পড়লেই ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠা। তাঁবুর গা যতটা সম্ভব বরফমুক্ত রাখা, অকারনে একে অপরকে চেঁচিয়ে ডাকা;এসব চলছিল যান্ত্রিক ভাবে। আমাদেরও মুখ আছে, নাম আছে; সেগুলো মনে থাকাটা অসম্ভব জরুরী হয়ে পড়ছিল। হতাশার পাল্লা একটু একটু করে ভারী হচ্ছিল। মেঘ কাটছিল না। বরফ পড়া থামছিল না। তাঁবু জলে ভাসছিল। আমাদের জ্যাকেট এবং স্লিপিং ব্যাগ, আমাদের শরীরের উষ্ণতা রক্ষার বদলে, শুষে নিচ্ছিল। আমরা অবশ হয়ে আসছিলাম। মৃত্যুকে মেনে নিচ্ছিলাম। চারদিন গড়িয়ে যেদিন পাঁচ, সেদিন চারদিক থেকে অ্যাভালাঞ্চ নামা আরম্ভ হল। আমরা ঘড়ি মিলিয়ে দেখলাম, প্রতি ছ মিনিটে একটা অ্যাভালাঞ্চ। একদম বুক কাঁপানো, হাড় হিম করা। এতদিন হিমবাহের মধ্যে দ্বীপের মত জেগে ওঠা একটা মোরেন দেওয়ালের মাথায় আস্তানা গেড়েছিলাম। গোটা হিমবাহে আমাদের এই ক্যাম্পসাইটকে মনে হয়েছিল সবথেকে নিরাপদ ঠিকানা। সেদিন সকালে সেই ক্যাম্পসাইটই যেন বলল, ভাই, অনেক রক্ষা করলাম তোমাদের। এবার তোমরা অন্য পথ দেখ। ক্যাম্পসাইট কথা বলে না, আমি জানি। নুড়ি পাথর, বড় বোল্ডার, মিছরি দানার মত বরফ; এরা কেউ কথা বলে না। কিন্তু এদের সঙ্গেই গত পাঁচদিন ধরে দিব্যি কথা বলছিলাম আমি। অনেক কথা। জমে থাকা, না বলা, ভুলে যাওয়া সব কথা। সব উজাড় করে ওদের বলছিলাম। আমার অস্তিত্ব ওদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল, আর ওদের ঔদাসিন্য আমার মধ্যে। তাই ক্যাম্পসাইট যখন উচ্ছেদের নোটিস হাতে ধরাল, তখন বললাম, যাব কোথায়? কীভাবে? চলার ইচ্ছেটাই চলে যাচ্ছে ক্রমশ। তুমি বরং একটা গল্প শোন। শুনবে? 

ক্যাম্পসাইট কিছু বলে না। সব শুনতে চায়। হয়ত সত্যিই সব শুনতে পায়। তাই বলে চলি। আমাদের পাড়ায় এক পাগল ছিল। নাম ছিল বিকাশ। অদ্ভুত ছিল তার পাগলামি। সোজা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিজেই নিজের পিঠে টোকা মারত। যেন পিছন থেকে কেউ তাকে ডাকছে। সঙ্গেসঙ্গেই পিছন ফিরে হাঁটা লাগাত সে। আবার কিছুক্ষণ পর সেই একই কাজ। নিজে হাতে নিজের পিঠে টোকা। নিজেকে পিছন থেকে ডাকা এবং অ্যাবাউট টার্ন। পাগলের আর কোথাও পৌঁছনো হত না। একসময় ওর এই পিছুটানের খেলা আমাদের কাছে একঘেয়ে হয়ে যেত। আমরা অন্যকিছু দেখতাম। ও ক্লান্ত হত না। ঘুরেই যেত। কিছুক্ষণ পর খেয়াল হতেই দেখতাম পাগল আর নেই। অদৃশ্য হয়ে গেছে। আমরা অবাক হয়ে যেতাম। ওর তো একই রাস্তায় ঘুরপাক খেয়ে মরার কথা ছিল! তাহলে ব্যাটা গেল কোথায়? আগে গেল? না পিছনে? ও কি এক পা এগোলে, দু পা পিছোয়? নাকি, উল্টোটা? ও কি সরলরেখায় হিসেব করে পা ফেলে? নাকি, ধীরে ধীরে বৃত্তের পরিধি ছোট করে আনে। তারপর এক নির্দিস্ট বিন্দুতে পৌঁছে হুস করে ভ্যানিস হয়ে যায়? ও কি মানুষ? নাকি, অন্য কোন ডাইমেনসন থেকে ভুল করে এসে আটকে পড়েছে বেলুড় বাজারে। সেই পাগল বিকাশকে অবশ্য দেখতে পাইনা আজকাল। সম্ভবত সে মারা গেছে কোন ফুটপাথে কুঁকড়ে শুয়ে। কিংবা, অন্য ডাইমেনসন থেকে ওর বন্ধুরা এসে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। এখন হয়ত ও বেশ ভাল আছে। আমি বলেই চলি। ক্যাম্পসাইট হাঁ করে শোনে। 

পাগলের গল্প কেন শোনালাম? আসলে আমার তখন মনে হচ্ছিল, আমরা সবাই পাগল। অবিকল সেই বিকাশের মত। আমাদের সভ্যতার মস্তিষ্ক বিকৃতি বিস্তর। তা না হলে, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর; বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে যাওয়া প্রকৃতির মৌলবাদ উপেক্ষা করে থাকি কী করে? সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, অদ্বৈত বেদান্ত এবং ঘুঁটে; সব সমান এই মৌলবাদের চোখে। সবই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আমরা কেন বুঝেও বুঝতে চাই না, সভ্যতার লক্ষ সমস্যার থেকে বড় বিষয়, প্রকৃতি। বারবার সে আমাদের সাবধান করে দেয়। আমরা হায় হায় করে উঠি। কখনও সুনামি, কখনও ভূমিকম্প, কখনও ক্লাউড বার্স্ট। কখনও নিকোবর, কখনও পাকিস্তান, কখনও উত্তরাখণ্ড। তবু বিস্ফোরণের আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই আমরা ফিরে যাই পটল কুমার কিংবা আইপিএল-এ। নিজের পিঠে নিজেই টোকা মারি। আবার পিছন ফিরে হাঁটি। আমরা পাগল নই? 

ছ নম্বর দিনে মেঘ কেটে যায়। একটুকরো নীল দেখা দেয়। আমরা নিঃশব্দে তাঁবু গুটিয়ে নামা শুরু করি। প্রকৃতির আরও এক হুঁশিয়ারির সাক্ষী আমরা। বার্তা পৌঁছে দিতে হবে বাকি বন্ধুদের কাছে। জানি কেউই শুনবে না আমাদের কথা। তবে হয়ত, পঞ্চাশ কিংবা একশো বছর পর কারো টনক নড়বে। তখন হয়ত অনেক দেরী হয়ে যাবে। বেলুড় বাজারের বিকাশ পাগলের মতই আমরাও ভ্যানিস হয়ে যাব। অন্য কোন ডাইমেনসনে ফিরে যাবার পথ আমাদের কোনদিনই ছিল না। আজও নেই। তবু সেই প্রাণ নিয়ে কোনমতে বেঁচে ফেরার মুহুর্তে আরও গভীর ভাবে ভালো লাগে ক্যাম্পসাইটকে। নিষ্প্রাণ হিমবাহকে বড় দয়ালু মনে হয়। মনে হয়, এই প্রকৃতি ঠিক আমার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের মত। বার্ধক্য, জরা পঙ্গুপ্রায় করেছে। তবু আমায় গভীর ভালবেসে তাঁরা বেঁচে আছেন। আর আমি ভাবছি, আগামীকালও ঘুম থেকে উঠে বাবাকে দেখব। একসঙ্গে চা খাব। মা বলবে, আজ আর কোথাও বেরোস না। বড্ড মেঘ করেছে।

সমাপ্ত 

লেখকের মন্তব্যঃ লেখাটি ২০১৬ সালে 'যারা পরিযায়ী'পত্রিকার পূজা সংখ্যায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল । লেখার সময় অমিতাভ ঘোষের 'দি গ্রেট ডিরেঞ্জমেন্ট'আমাকে প্রভাবিত করেছিল।  

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন- প্রথম পর্ব

$
0
0

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন -(প্রথম পর্ব)

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

(লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এবার নিজের ব্লগে দুটি পর্বে প্রকাশ করলাম। এটি প্রথম পর্ব। কৃতজ্ঞতা এবিপি প্রাইভেট লিমিটেড। ) 




পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, ইওরোপ-আমেরিকার পাহাড়িয়া আড্ডায়, পোড় খাওয়া এবং পোড় খেতে উদ্‌গ্রীব পর্বতারোহীদের মুখে মুখে একটা আলোচনা খুবই শোনা যেতআল্পসের শামোনি কিংবা ওয়েলসের প্লাস--ব্রেনিন, মাল্টি-পিচ কিংবা কোনও বোল্ডারিং সমস্যার শেষে, গ্রামের শুঁড়িখানায় বিয়ারের গ্লাসে ফেনার মতোই উপচে পড়ত একটা সম্ভাবনার কথাশোনা যেত, হিমালয় এবং কারাকোরামের উচ্চতম সবক’টি পাহাড় আরোহণ হয়ে গেলেই, পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবেবলা হত, তখন আর হাল্লা-চলেছে-যুদ্ধের কায়দায় বিশাল আকার-প্রকারের অভিযান সংগঠিত হবে নাতখন কেবল গুটিকয় বন্ধু, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবে। স্নোডনিয়া, লেক ডিস্ট্রিক্ট, কানাডিয়ান রকিস, সিয়েরা ক্যাসকেডস থেকে জারম্যাট-গ্রিন্ডেলওয়াল্ডের পাথর-বরফে ঘষা খেয়ে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হয়ে চলা নতুন ক্লাইম্বিং পদ্ধতি, শৈলী এবং সরঞ্জামের যথার্থ প্রয়োগের ক্যানভাস খুঁজে বেড়াবে এই নতুন প্রজন্মের পর্বতারোহীরা, হিমালয় এবং কারাকোরাম জুড়ে। বলা হত, আফটার অল, ক্লাইম্বিং ইস অলসো আ ফর্ম অফ আর্ট এবং আর পাঁচটা আর্ট ফর্মের মতোই পর্বতারোহণও বিবর্তিত, উন্নত, আধুনিক হবে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে

১৯৫৬ সালে, আজকের গিলগিট বাল্টিস্তান এবং শিনচিয়াং সীমান্তে মুজতাঘ টাওয়ারে ব্রিটিশ অভিযানের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছিল কারাকোরাম বা হিমালয়ের মতো প্রত্যন্ত পর্বতমালায়, ৭০০০ মিটারের শৃঙ্গে, কলোনিয়াল ঘরানার বাহুল্য বর্জন করেও অতি উচ্চ মানের টেকনিকাল ক্লাইম্বিং কী ভাবে করা যায়৭ জুলাই, ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস এবং জো ব্রাউন মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম শিখর আরোহণ করেছিলেন এবং ঠিক তার পরদিন, টম প্যাটি এবং জন হারটগ সেই একই রুটে মুজতাঘ টাওয়ারের পশ্চিম এবং পূর্ব সামিট ট্র্যাভার্স করেছিলেন। প্রখ্যাত পর্বতারোহী ট্রেভর ব্রাহাম ‘দি অ্যাল্পাইন জার্নালে’ লিখেছিলেন, “১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস ক্লাইম্বের থেকেও, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ১৯৫৬ সালের এই ক্লাইম্ব প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক ছিল”তার ঠিক পরের বছরই আরও এক নতুন ধরনের হাই-অল্টিচিউড ক্লাইম্বিং পদ্ধতি দেখা দিয়েছিল কারাকোরামে ৮০৪৭ মিটারের ব্রড পিকে। অস্ট্রিয়ার এই দলে ছিলেন মাত্র চারজন ক্লাইম্বার। কোনও শেরপা, হাই-অল্টিচিউড পোর্টার ইত্যাদি ছাড়াই ব্রড পিক আরোহণ করেও তাঁরা থেমে থাকেননিদল এবার দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা দু’টি ভিন্ন শৃঙ্গে আরোহণ শুরু করেছিলেন। দু’জন (মার্কাস শ্মুক এবং ফ্রিৎজ উইন্টারস্টেলার) আরোহণ করেছিলেন ৭৪২০ মিটারের এক অনামা শৃঙ্গ, আর অন্য দু’জন চেষ্টা করেছিলেন চোগোলিসা (৭৬৫৪ মিটার) ক্লাইম্ব করারএই দ্বিতীয় দলে ছিলেন হারমান বুল এবং কুর্ট ডিয়েমবার্গার। দুর্ভাগ্যক্রমে এই চোগোলিসাই ছিল প্রবাদপ্রতিম হারমান বুলের শেষ ক্লাইম্ব। কিন্তু, শিখর গিরিশিরার কর্নিস ভেঙে বুলের মতো পর্বতারোহীর চিরতরে হারিয়ে যাবার পাশাপাশি যে-স্বপ্নটা বিশ্বের পর্বতারোহীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তা হল— কয়েকজন বন্ধু মিলে হিমালয়-কারাকোরামের মতো বৃহত্তর পর্বতমালায় গিয়ে তাহলে কেবল একাধিক টেকনিকাল শিখরই নয়, আট হাজারি শৃঙ্গও ‘হারমান বুল স্টাইলে’ আরোহণ করা সম্ভব। এই চালচিত্র থেকে জাম্প-কাট করে যদি চলে আসি ১৯৮১ সালে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দক্ষিণ দেওয়ালে, তাহলে দেখতে পাব বিদ্যুৎ সরকারের নেতৃত্বে মাইকতোলি সহ মোট তিনটি বাইশ হাজার ফুটের শিখর আরোহণ করছেন গৌতম দত্ত এবং অমূল্য রায়। করছেন কোনও শেরপা কিংবা হাই-অল্টিচিউড পোর্টারের সাহায্য ছাড়াই। রামধনুর দুই প্রান্তের মতোই কারাকোরামে হারমান বুলের জন্ম দেওয়া স্বপ্নের ক্লাইম্বিং ঘরানা এবং দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল বাংলার এই পর্বতারোহীদের আইস-অ্যাক্সে ভর করে।

ইয়োরোপের আরও এক দশক পরে, অর্থাৎ, ষাটের দশকের শেষ দিকে এই বহুলচর্চিত সম্ভাবনার রশ্মি আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। ভারতের মধ্যে বাংলাই যে এই বিষয়ে অগ্রণী ছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। বইয়ের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক যে অনেক পুরনো! রামানন্দ ভারতী, সুকুমার বসু, শঙ্কু মহারাজ তো ছিলেনই, তবে সবার ওপরে এক নির্ভরযোগ্য ছাতার মতো ছিলেন উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়তাঁর সাগ্রহ পথপ্রদর্শনেই গড়ে উঠেছিল পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণে পথিকৃৎ একটি ক্লাব, হিমালয়ান ইনস্টিটিউট (পরে অ্যাসোসিয়েশন)। বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক স্বনামধন্য পর্বতারোহীর জীবনে অনুঘটকের ভূমিকায় আছে পর্বতারোহণ-সাহিত্য। অ্যালবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্টিফেন স্লেমন ‘অ্যাল্পিনিস্ট’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে সম্প্রতি লিখেছেন, “Most climbers aren’t born to the mountains: they read their way into them”বাংলার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই হয়েছিলহিমালয়ের কোলে কিংবা নিদেনপক্ষে পাদদেশে না জন্মেও, পর্বতারোহণ-সাহিত্যের হাত ধরেই দুনিয়া জুড়ে ক্লাইম্বিং-এর হালহকিকত বাঙালি অনুধাবন করেছিল ভারতের অন্য প্রদেশগুলির আগেই।

জো ব্রাউন আর ইয়ান ম্যাকনট-ডেভিস কিংবা জো টাস্কার আর পিটার বোর্ডম্যানের নাড়ির খবর বাংলার কিছু ক্লাইম্বার তখনই রাখতেন। ফলে, সবরকম প্রাদেশিকতার ঊর্ধ্বে উঠে আজ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, সাহিত্যের আলোকে অনুপ্রাণিত হয়েই সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক জুড়ে বাংলায় এসেছিল হিমালয়ের ক্যানভাসে অ্যাল্পাইন স্টাইলে পর্বত আরোহণের আর্ট এবং শেরপাদের কাঁধে ভর না করে নিজেদের ক্ষমতায় শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। সম্ভাবনাময় নতুন সেই অধ্যায়কে দীর্ঘজীবী করার রোমান্স থেকে বাঙালি বাদ যায়নি। বিদ্যুৎ সরকার, গৌতম দত্ত, প্রদীপ দাস, বনভূষণ নায়ক, অমূল্য রায়ের মতো আরও বেশ কিছু নাম দূরের তারার মতো চিকচিক করে উঠেছিল। তিরিশের দশকে হিমালয়-কারাকোরাম-আফ্রিকা দাপানো প্রবাদপ্রতিম জুটি এরিক শিপটন এবং বিল টিলম্যানের মতো, আটা ভাজা, ছাতু আর পাটালিগুড়ে হিমালয় ডিঙোনোর শক্তি, ’৭০-’৮০র দশকের এই একঝাঁক বাঙালি ক্লাইম্বাররাও আপন করে নিয়েছিলেন। অথচ আজ, এই ২০২০ খ্রিস্টাব্দে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয় যে, পর্বতারোহণের আধুনিক ধারায় পা রেখে নতুন অধ্যায়ের সূচনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নিনা, কেবল, এই বাংলা তথা ভারতবর্ষেই যে পর্বতারোহণের সেই প্রতিশ্রুত, যুগান্তকারী অধ্যায় আসেনি তা নয়; গোটা বিশ্বেই আসেনি। তার অন্যতম কারণ হল,বিগত তিন দশকে এই জমিতে বেনো জল ঢুকেছে বাঁধভাঙা বন্যার মতো। ফলে, পর্বতারোহণ জগতে নবাগতের পদার্পণ এবং যথাসময়ে উত্তরণের মুখ্য দার্শনিক শর্ত এবং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা বিষিয়ে গেছে। স্যার এডমন্ড হিলারি, ক্রিস বনিংটন, ডগ স্কট, ট্রেভর ব্রাহাম, জো ব্রাউন, ইভন শুইনা, রাইনহোল্ড মেসনার থেকে স্টিফেন ভেনাবলস— এঁরা সকলেই সহমত এই একটা ব্যাপারে।

নব্বইয়ের দশকে রব হল-গ্যারি বলের হাত ধরে সেই যে মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে ‘ফর সেল’ তকমা লেগেছিল আজ তা এক অতিমারির রূপ নিয়েছে। প্রথমে বাছা বাছা কিছু পাহাড়কে (যেমন কিলিমানজারো, ম্যাটারহর্ন, আকোঙ্কাগুয়া, এলব্রুস এবং মাউন্ট এভারেস্ট)ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল এবং তাদের পণ্য করে ইওরোপ এবং আমেরিকায় একের পর জন্ম নিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চার বেচার কোম্পানি— অ্যাডভেঞ্চার কনসালট্যান্টস, মাউন্টেন ম্যাডনেস, জ্যাগেড গ্লোব, অ্যাল্পাইন অ্যাসেন্টস ইত্যাদিতারপর, কয়েক বছর যেতে না যেতেই জন্ম নিল লোবেন এক্সপিডিশন, সেভেন সামিটস ট্রেকসের মতো অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের এবং নিম্ন মানের নেপালি কোম্পানিগুলিএভারেস্ট এবং সমগোত্রীয় সব ক’টি শৃঙ্গ পরিণত হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতেবলা হয়েছিল, স্বপ্ন সম্ভবের যুগ এসেছে, ফেলো কড়ি চড়ো এভারেস্ট— ব্যস, তুমিও রাতারাতি পরিচিত হবে অভিযাত্রী হিসেবেবলা বাহুল্য, এমন বিজ্ঞাপনে এসেছিল প্রবল সাড়াপ্রথমে ভিড় সামলাতে এবং তারপর সেই খদ্দের ধরে রাখতে, কয়েক বছর পার হতে না হতেই প্রয়োজন হয়েছিল ব্র্যান্ড এক্সটেনশনেরফলে সৃষ্টি হয়েছিলসেভেন সামিটস’, ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যামগোছের গালভরা নামের প্যাকেজ ট্যুরপ্রথম দিকে এই সব বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স সীমাবদ্ধ ছিল আর্থিক ভাবে সচ্ছল প্রথম বিশ্বের মানুষজনের মধ্যেএভারেস্টের এমআরপি ৬৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছিলআর এখন বাংলার গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি তার মায়ের গয়না, বাপের জমিজমা বন্ধক দিয়ে, যে-কোনও মূল্যে একটা আট হাজারের শিখরে উঠতে চাইছেকারণ, সে দেখতে পাচ্ছে এভারেস্ট বা সমতুল কিছু পাহাড়ে একবার উঠতে পারলেই টিভি এবং খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়া এ পোড়া দেশে নিশ্চিততার হয়তো মনে হয়েছে, মিডিওক্রিটি থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা নতুন শর্টকাটপর্বতারোহণের বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর সাফল্য তাই আজ এক অতি-ছোঁয়াচে সংক্রমণ। এক প্যানডেমিকের মতোই এই সংক্রমণ আজ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সব পর্বতমালায়, এমনকী দুই মেরুও বাদ যাচ্ছে নাএভারেস্ট, অন্নপূর্ণা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, মানাসলু, চোইউ, ধৌলাগিরি, লোৎসে ইত্যাদি শিখরের কথা বাদই দিলাম, বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর থাবা কে-টু কেও ছাড়েনি। বিগত দশ বছরে এই পশ্চিমবাংলা থেকে আট হাজারি শৃঙ্গ ‘জয়’ করতে যাওয়ার মিছিল তাই কোনও যুগান্তকারী ঘটনা নয়— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অযোগ্য, না হয় ট্যুরিস্ট ক্লাইম্বারদের (ক্ষেত্র বিশেষে দু’টিই) ইগো ট্রিপ। বাঙালির আট হাজারি শৃঙ্গের অভিমুখে যুদ্ধ ঘোষণার হিড়িক, সেই মাপকাঠিতে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং সেই দুর্ঘটনাগুলির কারণ বিশ্লেষণ করে ‘ড্রিম ওয়ান্ডেরলুস্ট’ নামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত রূপক ভট্টাচার্যের একাধিক নিবন্ধ এ বিষয়ে একাধারে একটি ‘মেটিকুলাস’ ময়নাতদন্ত সিরিজ এবং সতর্কবার্তা   আট হাজার মিটারের পাহাড়ে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের পর্বতারোহীদের দূর্ঘটনার বাৎসরিক পুনরাবৃত্তির কারণ যে মূলত সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড,সে প্রসঙ্গে ডঃ ভট্টাচার্য একজায়গায় লিখেছেন, “পর্বতারোহণ ঝুঁকির খেলা। এতে দুরকম প্রতিবন্ধকতা, অবজেক্টিভ এবং সাবজেক্টিভ। প্রথমটি পাহাড়জনিত, তার উচ্চতা, কাঠিন্য, আবহাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়টি পর্বতারোহীজনিত, তাঁর শিক্ষা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তাই পাহাড়ে ঘটা যেকোনো দূর্ঘটনার কারণ বিচার করতে হবে এই দুরকম মাপকাঠি দিয়ে। অবজেক্টিভ হ্যাজার্ড (প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা) সবার জন্য সমান। তফাৎ করে দেয় সাবজেক্টিভ হ্যাজার্ড। পর্বতারোহীর পর্বতারোহনের তাত্ত্বিক এবং ফলিত শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, মানসিকতা, স্বাস্থ্য, ইত্যাদি, যত পর্বত আরোহণের অনুকূল হবে তত কম হবে তাঁর ‘সাবজেক্টিভ’ প্রতিবন্ধকতা”।   

আট হাজারি শৃঙ্গগুলি জুড়ে মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজমের জমজমাট ব্যবসা এবং সেই ব্যবসায় খরিদ্দার হিসেবে ভারতীয়দের বিপুল সংখ্যায় যোগদানের বিষয়ে লিভিং লেজেন্ড রাইনহোল্ড মেসনার ২০১৭ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, “Climbing has totally changed. This year maybe 200 Indians will go to Everest on the piste [a track of firm snow] and since it is possible that Everest is prepared from the base to the summit, many people can go there. But this is not alpinism, this is tourism. People are buying the possibility to go up the piste on Everest. বিগত তিন দশকে বিশ্ব জুড়ে পর্বতারোহণ দর্শনের দৈন্য দেখে ডগ স্কট তো একেবারে রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যাদেরই পকেটে টাকা আর মনে ইনস্ট্যান্ট সেলিব্রিটি হবার শখ ছিল তারা তাদের সেই স্বপ্ন কিনতে পেরেছে”২০০৩ সালে বিবিসি-কে দেওয়া একটি ইন্টারভিউতে স্যার এডমন্ড হিলারি বলেছিলেন, “Having people pay $65000 and then be led up the mountain by a couple of experienced guides isn’t really mountaineering at all”আর এই ২০২০ সালের এপ্রিল মাসেঅ্যাডভেঞ্চার মাউন্টেন’ পত্রিকার এক ইন্টারভিউতে ক্রিস বনিংটন বলেছেন, “What’s happening on Everest? I mean, commercial expeditions on Everest have absolutely nothing to do with climbing whatsoever.”

তবে, বনিংটন-ডগ স্কটরা কী বলছেন এবং পর্বতারোহীদের মধ্যে কীরকম দার্শনিক এবং পরিণত ধ্যানধারণা থাকা উচিত, এসব বিষয়ে কথা বলা আজ এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যে ভস্মে ঘি ঢালার সমতুল্য। খবরের কাগজ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তাকালেই সেকথা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। এদেশে যারা এভারেস্ট, কিংবা সমতুল ঘরানার, অর্থাৎ, ৮০০০ মিটারের কোনও পাহাড়ে ওঠেন তাঁরাই রাতারাতি পূজিত হন। সেই পূজা পর্বতারোহণ-মূর্খ কোনও সাংবাদিকের উচ্ছ্বসিত রিপোর্টেই থেমে থাকে না, খোদ সরকার বাহাদুরও সময় বিশেষে এই দিগ্বিজয়ী বীরদের কখনও সম্মানীয় পদ কখনও সুবর্ণ পদক ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকেন। একবারও ভাবা হয় না যে, এই স্বঘোষিত, দিগ্বিজয়ী অভিযাত্রীরা আসলে শেরপা এবং স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাডভেঞ্চার কেটারিং সার্ভিসের সম্মানীয় ক্রেতা। যুবসমাজকে একবারও ভেবে দেখার সময় দেওয়া হয় না যে, মাউন্টেন ট্যুরিজম এবং মাউন্টেনিয়ারিং— এই দু’টির মধ্যে তফাত আকাশ এবং পাতালের, সোনা এবং সোনার পাথরবাটির। একই চিত্রনাট্য পুনরাবৃত্ত হয় ভারতীয় হিমালয়ে মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলির দ্বারা আয়োজিত ‘অভিযান’-এ। শেরপারা কাজ করেন, বাবুরা বলেন করেছি। বলেন, ফিক্সড রোপে জুমার লাগানো দেখতে পাচ্ছেন তো কী হয়েছে, আসলে আমরা নিজেরাই ক্লাইম্ব করেছি; জুমার তো প্রপঞ্চময় মায়াসত্যি, কম ঝক্কি পোয়াতে হয় শেরপা ভাইদের! এদিকে, এই সমস্ত ‘গাইডেড’ এবং ‘ফুল সার্ভিস’ অভিযান যে আদতে কুণ্ডু ট্রাভেলসের সঙ্গে চারধাম ভ্রমণের হাই-অল্টিচিউড ভারশন, তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাই না। এক্সপিডিশন থেকে ফেরা বাংলার বনিংটনরা তার পর থেকে দূর্গাপুজার ফিতে ছাড়া আর কিছু কাটেন না এবং দেখা দেন আগামীকালের পর্বতারোহণের উপদেষ্টা, এমনকী, নীতিনির্ধারক রূপেএতক্ষণে, পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন যে, পিউরিস্ট পর্বতারোহীদের একসময়ে দেখা উত্তরণের স্বপ্ন, ঠিক কোন বেনো জলের প্লাবনে বাংলায় দানা বাঁধতে পারেনি! নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, স্বল্প সময়ের জন্য সীমিত মানুষজনের মধ্যে সেই চেতনা এসে থাকলেও, কেন তা সর্বব্যাপী এবং দীর্ঘমেয়াদি হয়নি।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্ত  

(দ্বিতীয় পর্বের লিংক)

Illustration courtesy: Freevector 

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন - দ্বিতীয় পর্ব

$
0
0

পর্বতারোহণঃ একটি ছিন্নডানা স্বপ্ন - দ্বিতীয় পর্ব 

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় 

(লেখকের মন্তব্যঃ এই লেখাটি দেশ পত্রিকায় ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে এবার নিজের ব্লগে দুটি পর্বে প্রকাশ করলাম। এটি  দ্বিতীয় পর্ব। কৃতজ্ঞতা এবিপি প্রাইভেট লিমিটেড। ) প্রথম পর্বের লিংক



বিশ্বের প্রেক্ষাপটে পর্বতারোহণের সেই প্রতীক্ষিত উত্তরণের অধ্যায় শেষ পর্যন্ত না আসার কারণটা অবশ্য বাংলা কিংবা ভারতের মাটিতে বেনো জল ঢোকার মতো সরল নয়। বিষয়টি যেহেতু অনেকটাই ইতিহাসনির্ভর তাই এডওয়ার্ড হোয়াইম্পার এবং ম্যাটারহর্ন পাহাড়ের প্রসঙ্গ আসা অবশ্যম্ভাবী১৮৬৫ সালে হোয়াইম্পারের নেতৃত্বে ম্যাটারহর্ন শিখর আরোহণকেই ইতিহাসকাররা মোটামুটি ভাবে ইওরোপিয়ান অ্যাল্পিনিজম তথা পর্বতারোহণের জন্মলগ্ন হিসেবে ধরে থাকেন। সেই আরোহণের পর এডওয়ার্ড হোয়াইম্পার লিখেছিলেন, “পৃথিবী আমাদের পদতলে ছিল এবং ম্যাটারহর্নকে আমরা জয় করে ফেলেছিলাম”আজকাল বেশ কিছু পর্বতারোহী বন্ধু (তাদের মধ্যে ভারতীয় প্রায় নেই বললেই চলে) অবশ্য বলে থাকেন, তাঁরা আর সামিটে দাঁড়িয়ে পতাকা ওড়ানোর ধার ধারেন না। তাঁদের কাছে আরোহণের বিশুদ্ধতাটাই মোক্ষ। ‘কী ক্লাইম্ব করছির থেকে কী ভাবে ক্লাইম্ব করছি’- এটাই তাঁদের আনন্দ এবং প্রাপ্তির মাপকাঠি এবং মাইলফলক। তাছাড়াও, তাঁরা এমন কিছু বলতে বা করতে চান না যাতে তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত অ্যাডভেঞ্চার ‘মানুষ প্রকৃতিকে জয় করল’ গোছের এক মুখোশ পরে জনসমক্ষে এসে দাঁড়ায়তাঁরা মনে করেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে বিংশ শতাব্দী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অভিযাত্রীদের ভূরিভূরি ‘তথাকথিত’ বিজয়গাথা সাধারণভাবে প্রকৃতি এবং বিশেষভাবে স্থান-কাল-পাত্রের প্রতি এক সীমাহীন অবজ্ঞার প্রতীক। কারণ, বিজিত পাহাড়ের প্রাচীন, স্থানীয় নাম বদল করেই এইসব অভিযাত্রীরা ক্ষান্ত হননি, যে-মালবাহক এবং স্থানীয় গাইডের হাত ধরে তাঁরা তাঁদের অভীষ্টের কাছে পৌঁছেছিলেন, তাদের অবদান, তাদের গল্প, তাদের সংগ্রামের কথা একরকম অদৃশ্যই রেখেছেন সংশ্লিষ্ট অভিযানের বিবরণে এবং সাহিত্যেএ তো নেহাত আনমনে ভুলে যাওয়া নয়, বরং জাত্যাভিমানে মদমত্ত এক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিসন্ধি। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হিমালয় জুড়ে এরিক শিপটন এবং বিল টিলম্যানের দুর্দান্ত সব কীর্তি তো আজ হিমালয়সাহিত্যের পাঠক মাত্রেই জানেন, কিন্তু যে তিনজন শেরপা ছাড়া অসম্ভব ছিল তাঁদের অভিযান সফল হওয়া, সেই পাসাং, কুসাং এবং আং থারকের কথা তাঁরা তো বিশদে কখনই কোথাও লেখেননি! এরকম উদাহরণ বিস্তর রয়েছে, তবে আপাতত এই একটিই যথেষ্ট

আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করছি, যখন সময়ের সরণি বেয়ে মানবজাতির প্রতিটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত এবং ফলস্বরূপ বদলে যাওয়া জীবনযাত্রার অভিমুখ আমাদের নতুন করে, গভীর ভাবে ভাবতে এবং পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে। পর্বতাভিযান যেহেতু কোনও ইতিহাসবহির্ভূত ঘটনা নয়, তাই বিশ্লেষণ এবং পুনর্মূল্যায়নের জরুরি তালিকায় সেটিও পড়ে। বিশ্বের কিছু শিক্ষিত, সমাজসচেতন পর্বতারোহীর কাছে মাউন্টেনিয়ারিং আর কেবল ‘পাহাড়-পাহাড় খেলা’ নয়। যে-অভিযানের মধ্যে পরিবেশের প্রতি সচেতন দায়িত্ববোধ, সামাজিক মূল্যবোধ, মানবিক মমত্ব এবং শিক্ষার অবকাশ নেই, সে অভিযান ভ্রান্ত, সে অ্যাডভেঞ্চার পথভ্রষ্ট এবং অপ্রয়োজনীয়। তাঁদের মতে, একটা আরোহণের বিচার হওয়া উচিত পরিবেশের ওপর সেই অভিযানের প্রভাব, মালবাহকদের শ্রম, শেরপাদের করা ফিক্সড রোপ এবং সেই অভিযান থেকে কোনও সুদূরপ্রসারী ভাল কাজ কিংবা শিক্ষার সূত্রপাতের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে। বিগত শতাব্দীর কলোনিয়াল ঘরানার পর্বতাভিযান, যা আসলে ঔপনিবেশিকদের সাম্রাজ্যবিস্তার ষড়যন্ত্রের অন্যতম একটি অস্ত্র ছিল, তাকে আজকের দিনেও কেন আমরা খোলা ছাড়পত্র দেব কেবলই গুণকীর্তনে? শিক্ষা নিশ্চয়ই নেব সেই সব অভিযান থেকে, তবে প্রশ্নাতীত কেন থাকবে তাঁদের উদ্দেশ্য এবং কাজকর্ম? এমন অনেক কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরে, পাশ্চাত্যের পর্বতারোহণ চর্চায় ইদানীংকালে আলোড়ন তুলেছেন পর্বতারোহণ স্কলার অমৃতা ধর। অমৃতার যুক্তিগুলি গবেষণালব্ধ, ফলে অকাট্য। তাই কেউ-কেউ পাশ কাটিয়ে গেলেও, মূলত সাদাচামড়া অধ্যুষিত বিশ্ব পর্বতারোহণের দুনিয়ার বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার কাজটি অমৃতা করে দিয়েছেন

এ প্রসঙ্গে তরুণ ব্রিটিশ চিত্রকর রিচার্ড টি ওয়াকারের ২০১৫ সালের কাজ ‘দি ফলিবিলিটি অফ ইনটেন্ট’ উল্লেখযোগ্য। ওয়াকার এই কাজটি করেছেন আর্কাইভাল পিগমেন্ট প্রিন্টে এবং মূল উপাদান হিসেবে বেছে নিয়েছেন হোয়াইম্পারের ১৮৭১ সালের বই ‘স্ক্র্যাম্বলস অ্যামংস্ট দি আল্পস’-এ ব্যবহৃত ম্যাটারহর্নের একটি সাদাকালো ছবি। ওয়াকার বইয়ের ছবিটিকে কেটে বসিয়েছেন তাঁর ক্যানভাসের উপত্যকায়, আর তারপর তার শীর্ষবিন্দুটিকে ঢেকে দিয়েছেন এক গাঢ় লাল ভাসমান বৃত্তেম্যাটারহর্ন পাহাড়ের ভূগোল বদলে দিয়ে শিল্পী চেয়েছেন পর্বতারোহণের চিরাচরিত ঔপনিবেশিক প্রবণতা এবং আকাঙ্ক্ষাগুলিকে অস্বস্তিতে ফেলে দিতে। দর্শক বুঝতে পারছেন লাল বৃত্তটি ম্যাটারহর্নের শিখরকে আড়াল করে রেখেছে, কিন্তু দেখতে পাচ্ছেন না। শিল্পী বলতে চেয়েছেন, যুদ্ধজয়ের কায়দায়, যে-কোনও মূল্যে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে বিজয় ঘোষণা করতে হবে— পর্বতারোহীদের মধ্যে চলতে থাকা এই প্রবণতাটিই একটি গড্ডলিকাপ্রবাহ এবং এও এক ধরনের ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারতাঁর মতে, শিখর দেখতে পেলেই তার মাথায় যেন তেন প্রকারেণ উঠে পড়ার ট্র্যাডিশন আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও ঐতিহাসিকভাবে তা ভ্রমশীল। শিখর আড়াল করে থাকা ওয়াকারের লাল বৃত্ত তাই অনেকটাই রহস্যের অবকাশ, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ এবং প্রতিরোধের চিহ্ন। তাহলে কি বিশ্বের পর্বতারোহণের সেই অধ্যায়, যার আসার কথা ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আসতে পারেনি, তার অসাফল্য এইরকম এক ভ্রান্ত, অন্তঃসারশূন্য উত্তরাধিকারের ভার নীরবে বয়ে চলারই পরিণাম? নাকি, চিন্তাহীন অপরিণামদর্শিতা ছাড়াও অন্য কোনও বাড়তি ফ্যাক্টর এখানে কাজ করেছে?

 

অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের আস্ফালনে আমাজনের কায়াপো, সিকিমের লেপচা, কেনিয়ার মাসাই, চিনের ঈ, কালাহারির বুশম্যান, এবং গ্রিনল্যান্ডের ইনুইট আজ নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি ভুলতে চলেছে। ‘কর্পোরেট গ্রিড ওভার হিউম্যান নিড’-এর সন্ত্রাসে প্রকৃতি আজ বিধ্বস্ত, জীববৈচিত্র সন্ত্রস্তইউনিফর্মিটির সঙ্গে সম্মুখসমরে ডাইভার্সিটি পরাস্ত। মধ্যমেধার নবজাগরণ এবং তার গণ-উদ্‌যাপনের ফলে আজ ঠিক একই ভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরম্যালোরির ‘বিকজ় ইট ইস দেয়ার’ কিংবা চেস্টারটনের ‘থিং’ (যেটি আসলে কোন একটি বিষয় সম্বন্ধে মানুষের ধ্যানধারণা এবং সেই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সেই মানুষটির আচার-ব্যবহারের একটি অভিজ্ঞতালব্ধ আলোচনা) — সবকিছুরই প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। পর্বতারোহণ দুনিয়ার এই সামুহিক অবক্ষয়ের অভিমুখ দেখেই ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইম্বিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন (Union Internationale des Associations d'Alpinisme- UIAA)এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন যা আজদি টিরল ডিক্লেয়ারেশননামে পরিচিতটিরল ঘোষণায় একটা কথা পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছে, বিপদ এবং অনিশ্চয়তা ব্যতীত ক্লাইম্বিং তার প্রকৃত পরিচয়, তার সংজ্ঞায়িত উপাদান হারায়— এবং তা হল অ্যাডভেঞ্চারWithout danger and uncertainty climbing loses its defining element-adventure”

এদিকে বিশ্বের পর্বতারোহণ ম্যাপে যুক্ত হয়েছে নতুন এক শ্রেণিএঁরা নিজেদের মাউন্টেনিয়ার কিংবা অ্যাল্পিনিস্ট নয়, পরিচয় দিচ্ছেন মাউন্টেন অ্যাথলিটহিসেবেএকের পর এক শিখর জুড়ে, তা আল্পসই হোক কিংবা হিমালয়, গত দশ বছরে আমরা যে স্পিড রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখছি, তাতে একটাই প্রশ্ন বারবার ফিরে আসছে। পর্বতারোহণ কি অলিম্পিক গেমসের একটা ইভেন্টে পরিণত হয়েছে? ২০১৩ সালে, এভারেস্টের লোৎসে ফেসে উয়েলি স্টেক-সিমোনে মোরোদের সঙ্গে শেরপাদের হাতাহাতি-রেষারেষি পৃথিবীর সামনে এক চরম অস্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরেছে। ঘটনাটি, এভারেস্টে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিবছর রুজিরুটির তাগিদে ফিরে আসা শেরপাদের সংগ্রামের সঙ্গে এ যুগের মাউন্টেন অ্যাথলিটদের গ্যালারি শট নেবার প্রবণতার একটি প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ। ফি বছর আরও বিচিত্র, আরও কঠিন, আরও দ্রুত গতির কিছু চমক জাগানো ক্লাইম্ব করাকে উয়েলি স্টেক বলতেন তাঁর ‘বিজনেস’। এভারেস্টের সেই তিক্ত ঘটনার পর ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উয়েলি স্টেক বলেছিলেন, “To make business, you need stories. To create stories, you need to come up with projects—bigger and bigger ones with each passing years—and then you need to succeed at them”২০১৭ সালে নুপৎসে শিখরে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় উয়েলি স্টেক শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন তার জন্যও সেইবিগার অ্যান্ড বিগারপ্রজেক্ট করার দর্শন দায়ী বইকিআজ ইন্টারনেট জুড়ে প্রতিনিয়ত এক-একজন স্পনসরড মাউন্টেন অ্যাথলিটেরবিগার অ্যান্ড বিগার-এর পিছনে ছোটা দেখে তাই কখনই বিখ্যাত ইতালীয় অ্যাল্পিনিস্ট ওয়াল্টার বোনাত্তির সেই উক্তি মনে পড়ে না: “What is there, beyond the mountain, if not the man?” একইভাবে, ইদানীংকালে হিমালয়- কারাকোরামে অভিযানগুলোর খবর দেখলে বা শুনলে বোঝা যায়, প্রচার পাবার মরিয়া প্রচেষ্টায় দলগুলি যা-খুশি তাই করতে প্রস্তুত। প্রাথমিক ভাবে স্পনসর জোগাড় এবং তারপর সেই স্পনসরকে টিকিয়ে রাখার তাড়নায় আজকের একশ্রেণির পর্বতারোহীরা মোটা দাগের চিত্রনাট্য শুধু নয়, প্রাণের বাজি রাখতেও রাজি। আট হাজার মিটারের পাহাড় হোক কিংবা আল্পসের কোনও নর্থ ফেস, খবরে থাকার জন্য এই পর্বতারোহীরা যে-কোনও মাদারি-কা-খেল দেখাতে প্রস্তুত। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন একটাই উঠে আসে, এঁদের পর্বতারোহণের মুখ্য উদ্দেশ্য তাহলে আজ কোন পর্যায়ে নেমে এসেছে? ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি? রাতারাতি সেলিব্রিটি হবার প্রলোভন? উয়েলি স্টেকের ‘বিগার অ্যান্ড বিগার’? নাকি, বিশ্বের কাছে নতুন কিছু প্রমাণ করে দেখানোর তাগিদ?

তবে বিশ্বের প্রেক্ষাপটে সেই স্বপ্নের প্রত্যাবর্তনের আশার পাল্লা ভারীকারণ, বাংলা তথা ভারতে যখন পর্বতারোহণ জগতের কলকাঠি নাড়েন অপদার্থের দল, ওদের পর্বতারোহণ জগতের মূলস্রোতে এখনও বিচরণ করেন পিউরিস্ট, ক্লাসিক ঘরানার অভিযাত্রীরাজেরলিন্ডে কাল্টেনব্রুনারের সঙ্গে কে-টু আরোহণ করা পোলিশ পর্বতারোহী দারিউস জালুস্কি ২০১৯ সালে আমাকে বলেছিলেন, “পাহাড় আমার স্টেডিয়াম নয়, পাহাড় আমার থিয়েটারদারিউসের কথায় আমার মনে পড়েছিল, ১৯৮৫ সালে গাশেরব্রুম-৪ শৃঙ্গের পশ্চিম দেওয়ালে আটকে পড়া আর এক পোলিশ পর্বতারোহী ভয়টেক কুর্তিকার কথাকুর্তিকা এবং রবার্ট শাউয়ার সেবার ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করে ফেলেছিলেন, কিন্তু শিখর তখনও দূরে ছিলকুর্তিকা বুঝতে পেরেছিলেন, আর এগোলে মৃত্যু নিশ্চিততাই দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেমে আসারসামিটে না গেলেও বিশ্বের পর্বতারোহী মহল তাঁদের এই ক্লাইম্বকে অসম্পূর্ণ বলেননিসেই প্রসঙ্গে কুর্তিকা বলেছিলেন, “এর থেকে বোঝা যায়, অ্যাল্পিনিজম আসলে স্পোর্টনয়, এটি একটি আর্টOnly in art does a missing link contribute to the meaning of a piece”অসম্ভবের সীমারেখায় ছবি আঁকা এই ক্লাইম্বিং রুট দেখে কেউ কেউ একে শতাব্দীর সেরা ক্লাইম্বতকমা দিতে চেয়েছিলেনতার জবাবে কুর্তিকা বলেছিলেন, “কোনও একটি বিশেষ কবিতাকে কি কখনও শতাব্দীর সেরা কবিতা বলা যায়?” তাই, কুর্তিকা এবং দারিউসের দেখানো দর্শনের ওপর ভরসা রেখে, আজ মনে হয় আবার নতুন করে এক সরল এবং নান্দনিক স্বপ্ন দেখা শুরু করা যায়। ভেবে নেওয়াই যায়, জয়পতাকা ওড়ানোর অভিপ্রায়ে নয়, আবার একদিন বাংলায় সেদিন আসবে যেদিন অভিযান হবে নির্ভেজাল আনন্দের খোঁজে। নিজেদের ক্ষমতা, শৈলী এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে প্রথমে ছোট ছোট শৃঙ্গ দিয়ে হাত পাকাবেন তাঁরা। তারপর একদিন কেবল গুটিকয় বন্ধু মিলে, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবেনঠিক যেমন ভাবে একদিন ফিনিক্সের মতো, পোলিশ অভিযাত্রীরা তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের বুক থেকে। পর্বতারোহণ সেদিন হবে আত্মিক উত্তরণের সোপান, বেঁচে থাকার উদযাপন— আ সেলিব্রেশন অফ লাইফ ইটসেলফ।

 

সমাপ্ত

Illustration courtesy: Freevector


লকডাউন স্বগতোক্তি ৪ - স্টেলমেট

$
0
0


দাবা খেলাটা কোনোদিনই খুব ভাল খেলতে পারতাম না। বুদ্ধিমাণ, বিচক্ষণ, ধৈর্যশীল, দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষের মত সুচতুর কৌশলী পদক্ষেপ ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়া, আর যার হোক এ অধমের কম্মো নয়। এই সত্য অনেক ছোটবেলাতেই  হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম। 

লকডাউনে সেই সত্য আবার মনে করিয়ে দিল কম্পিউটার। স্টকফিশ লেভেল থ্রি-র সঙ্গে হেবি ফাইট করেও শেষমেশ সেই স্টেলমেট।  বিপক্ষকে ক্ষমতাশূণ্য করে দিয়েও জেতা হল না। 

অনেকটাই ঠিক জীবনের মত। 

আচ্ছা স্টেলমেটই যদি সারসত্য তাহলে খেলছি কেন এই খেলা?  একদিন ঠিক চেকমেট হবে, এই আশায়? নাকি, জীবনের শেষে স্টেলমেট অনিবার্য জেনেও খেলতে হয়? 



 

ইন্দ্রবর্মার হাতি

$
0
0

আমরা জানি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অশ্বত্থামা ছিলেন কৌরবদের পক্ষে। এদিকে ছেলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন না বলেই গুরু দ্রোণও কৌরবদের পক্ষেই দাঁড়ান।  যথারীতি, যুদ্ধে দ্রোণাচার্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন। পাণ্ডবদের মধ্যে ওঠে ত্রাহি ত্রাহি রব। তখন শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের বলেন কোনও ভাবে যদি গুরু দ্রোণের কানে অশ্বত্থামার মৃত্যুর 'ভুল'খবর পোঁছানো যায় তাহলে দ্রোণ আর মারদাঙ্গা করবেন না। আর সেই সুযোগে, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে হত্যা করবে। 

প্ল্যানমাফিক, ভীম মালবরাজ ইন্দ্রবর্মার অশ্বত্থামা নামক একটি নিরীহ হাতিকে হত্যা করেন এবং সেই হত্যার সাক্ষী রাখা হয় যুধিষ্ঠিরকে। সবাই জানত, আচার্য্য দ্রোণ, আর যাই হোক যুধিষ্ঠিরের কথাকে অবিশ্বাস করবেন না, কারণ তিনি একজন বেঞ্চমার্ক সত্যবাদী ছিলেন কিনা। ব্যস, এরপর একজন নিষ্ঠাবান সাংবাদিকের মত যুধিষ্ঠির দ্রোণকে জানান যে, 'অশ্বত্থামা হতঃ- ইতি গজ'। 

কিন্তু সেই সংবাদ পরিবেশনে একটা মোক্ষম চাল ছিল। যুধিষ্ঠির, 'অশ্বত্থামা  হত'- এইটুকু চেঁচিয়ে বলেন এবং 'ইতি গজ' - টুকু বলেন স্বর নামিয়ে, মিনমিন করে। একে বয়স হয়েছে, তার ওপর ধুন্ধুমার ধর্মযুদ্ধ চলছে, তার মধ্যে খোলা মাঠে একটু দূর থেকে যুধিষ্ঠির চেঁচিয়ে কীসব বলছে। স্বাভাবিক ভাবেই ঐ 'ইতি গজ'  অংশটুকু  দ্রোণাচার্য্য আর শুনতে পাননি।  

এর ফল কী হয়েছিল আমরা আজ তা সকলেই জানি। 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ 

সম্প্রতি কাগজের হেডলাইন জানিয়েছে বোতলের অক্সিজেন ব্যবহার না করেই নাকি একজন বাঙালি মাউন্ট এভারেস্টে উঠে পড়েছেন। খুবই আনন্দের কথা। কিন্তু, হেডলাইন টপকে মূল খবরের মধ্যে ঢুকে দেখি লেখা আছে ব্যাপারটা নাকি ঘটেছে  - 'almost'- 'প্রায়'। অর্থাৎ, উনি পুরো রাস্তাটা বোতলের অক্সিজেন ছাড়া  মোটেই ওঠেননি- বরং আরোহণের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেনের সাহায্য নিয়েই উঠেছেন। 

এদিকে আমাদের সাংবাদিকেরা তাঁকে গ্রেস মার্ক দিয়ে পাস করিয়ে দিয়েছেন। ভাবখানা এরকম যে, "আহা, আর একটু হলে তো উঠেই পড়ত! যেটুকু করেনি সেটা আব্বুলিশ!"  অনেকটা সেই 'ইতি গজ'টাইপের ব্যাপার আর কী! 

অবশ্য, সেযুগের যুধিষ্ঠিরের তুলনা এখনকার সাংবাদিকদের সঙ্গেই একমাত্র চলে। বর্তমান যুগের সত্যনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার কথা তো সকলেরই জানা। এই সাংবাদিকেরা তাই সময় সুযোগ পেলেই সেই সুপ্রাচীন 'ইতি গজ'পদ্ধতি তাঁদের 'নিজেদের ধর্মযুদ্ধের'খাতিরে প্রয়োগ করে থাকেন। তাঁদের লেখা হেডলাইনের বিজয় ঘোষণায় হৈহৈ পড়ে যায়। সেই হুল্লোড়ে 'প্রায়'ব্যাপারটা কোথায় যেন ভেসে যায়। 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ 

এখন প্রশ্ন হল, ভবিষ্যতে এই বাংলারই কেউ যদি  এভারেস্টের সামিট পর্যন্ত বিনা- সাপ্লিমেন্টারি অক্সিজেনে  সত্যি সত্যিইযান ( আশা করি যাবেন), তাহলে তখন এই 'ইতি গজ'হেডলাইন গুলোর কী গতি হবে? 

এবং তার থেকেও বড় প্রশ্ন, ইন্দ্রবর্মার হাতির মত আরও কত সত্যিকার সম্ভাবনা আজকের যুধিষ্ঠিররা  হত্যা করবেন?  

অরণ্যে রোদন

$
0
0

সবসময় নয়, তবে মাঝেমধ্যে কিছু লেখার একটা তাগিদ আমার মধ্যে কাজ করে বলেই একসময় https://himalaya-raja.blogspot.com/  এই ব্লগ পেজটা খুলেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম- 'Soliloquy of a Wandering Pilgrim or In Dialogue with Destiny'। 

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এটি একটি বিচিত্র নাম। এই বলছি 'সলিলোকি', আবার পরমুহুর্তে বলছি 'ডায়ালগ'। আসলে আমার মনে হয়েছিল স্বগতোক্তিও একধরণের আলাপচারিতা হতে পারে- হোক না তা নিজের সঙ্গেই। নিজের ব্লগে লিখতে পয়সা লাগে না এবং কাউকে জবাবদিহিও করতে হয় না! তাই জন্যই আমার এই ব্লগ পেজ।  নিজের যা খুশী, যখন খুশী লিখব- এই ভেবেই খুলেছিলাম। আবার যদি কোনদিন ইচ্ছে হয় তখন বন্ধ করে দেব লেখা। কেউ তো মাথার দিব্যি দেয়নি যে লিখতেই হবে।   

সেইরকমই একটা ছোট লেখা কয়েকদিন আগে লিখেছিলাম এখানে। নাম দিয়েছিলাম-'ইন্দ্রবর্মার হাতি'। বাংলার পর্বতারোহণের ভাগ্যাকাশে ঘটে যাওয়া ইদানীংকালের একটা ভেল্কিবাজি ছিল সেই লেখার বিষয়। (প্রসঙ্গান্তরে বলে রাখি বাংলার আট হাজার মিটারি পর্বতারোহণের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে এরকম আরও বেশ কিছু ভেল্কিবাজির ঘটনা রয়েছে) 

যাইহোক, ইন্দ্রবর্মার সেই হাতি নাকি পর্বতারোহীঠাসা দুয়েকটা সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপেও পৌঁছেছিল।  কিন্তু সেই লেখা পড়ে কারও কিছু আসে যায়নি। কেউ কোন মন্তব্যও করেননি- স্রেফ অগ্রাহ্য কিংবা উপেক্ষা করে গেছেন। পাহাড়িয়া লোকজনের এইরকম নির্বিকল্প সমাধী দেখে আমার কয়েকজন হিমালয়প্রেমী বন্ধু অবাক হলেও, আমি হইনি। বরং ভারী আমোদ হয়েছিল এই ভেবে যে- বাংলার পর্বতারোহণ জগতে আমার 'ইন্দ্রবর্মার হাতি'ইংরাজি  বাগ্ধারা '(The) Elephant in the room'- এর সত্যতা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই প্রমাণ করতে সফল হয়েছে। 

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ 

আসলে গোড়ায় গলদ হয়েছে 'মাউন্টেনিয়ারিং ট্যুরিজম'এবং 'মাউন্টেনিয়ারিং'- এই দুটো ব্যাপারকে জনমানসে সমার্থক হয়ে যেতে দেওয়ায়।  সোনা এবং সোনার পাথর বাটিকে তো একই গোত্রে ফেলে দিয়েইছো- এবার বোঝো ঠ্যালা!  কী ভাবে এই ভাবের ঘরে চুরি হল সেই নিয়ে একটা বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করা যেতে পারে এবং পাঠকদের মধ্যে কেউ এই নিয়ে সত্যিই পড়াশুনো করতে চাইলে অনেক উপাদান তাঁদের নাগালের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। 

তাই আর বিশদে না গিয়ে বলতে চাইছি, মধ্যমেধার নবজাগরণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার অসীম ক্ষমতায়ন এবং তার গণ-উদ্‌যাপনের ফলে আর পাঁচটা বিষয়ের মতই নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরও। ম্যালোরির ‘বিকজ় ইট ইস দেয়ার’ কিংবা চেস্টারটনের ‘থিং’ — সবকিছুরই প্রকৃত অর্থ হারিয়ে গেছে। একটা অস্পষ্ট দর্শনের ( Philosophy of fuzziness) পতাকা পতপত করে উড়ছে সর্বত্র। তাই 'almost done'টাও 'done'হয়ে যাচ্ছে নির্বিরোধে এবং নির্বিচারে চলে আসছে সংবাদ শিরোনামে। একটা মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাচ্ছে সত্যে। 

হাই- অলটিচিউড মাউন্টেন ট্যুরিজম ভালো, পর্যটন শিল্পের জন্য ভালো, পর্যটন কর্মীদের জন্য ভালো, পাড়ায় ফিরে কলার তুলে হাতির পিঠে চেপে সম্বর্ধনা নেবার জন্য ভালো- কিন্তু তাই বলে টুরিস্ট মাউন্টেনিয়ার কখনই প্রকৃত মাউন্টেনিয়ার হয়ে যায় না। জেফ বেজোস কিংবা ইলন মাস্কের রকেট চেপে মহাকাশ সফর সেরে এলেই যেমন কেউ নভশ্চর হয়ে যান না, ঠিক সেরকম কোন ট্র্যাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ট্যুরে এভারেস্ট ( এবং তারপর ফি-বছর আরও ৮০০০ মিটারি) চড়েও কেউ মাউন্টেনিয়ার হয়ে যান না। 

তবে কিছুটা দুঃখজনক  স্বান্তনার কথা হল যে, এই টুরিস্ট ক্লাইম্বিং-এর উপদ্রব কেবল বাংলায় নয়, সারা বিশ্বেই বেড়েছে কমবেশি।  এই সামুহিক অবক্ষয়ের অভিমুখ দেখেই ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ক্লাইম্বিং অ্যান্ড মাউন্টেনিয়ারিং ফেডারেশন (Union Internationale des Associations d'Alpinisme- UIAA) এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা করেন যা আজ ‘দি টিরল ডিক্লেয়ারেশন’ নামে পরিচিত টিরল ঘোষণায় একটা কথা পরিষ্কার ভাবেই বলা হয়েছেবিপদ এবং অনিশ্চয়তা ব্যতীত ক্লাইম্বিং তার প্রকৃত পরিচয়তার সংজ্ঞায়িত উপাদান হারায়— এবং তা হল অ্যাডভেঞ্চার Without danger and uncertainty climbing loses its defining element-adventure”। 

এজেন্সিরা যে প্যাকেজগুলি বিক্রি করেন তার নাম 'অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজম', 'অ্যাডভেঞ্চার'নয়- তা সে মাউন্ট এভারেস্টও হতে পারে, সেভেন সামিটস হতে পারে, আবার এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যাম-ও হতে পারে।  যেমন গালভরা প্যাকেজের নাম, তেমনই যুতসই তার দাম।  এই পদ্ধতিতে পাহাড় চড়ে (কিংবা মেরু বিজয় করে) কারও ব্যক্তিগত শখ মেটে বটে, তবে তা সমাজকে কিছু দেয়না। তাই কেউ নিজের কিডনি বেচে, কিংবা বাপের জমি বন্ধক রেখে  এজেন্সিকে পয়সা দিতে পারছে, কি পারছে না, তা কখনই একটা সামুহিক বিবেচ্য বিষয় কিংবা সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিচায়ক হওয়া উচিৎ নয়।  

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

কিন্তু এতসব কিছু জানা সত্ত্বেও যখন সেই টুরিস্ট ক্লাইম্বিং-কেই একটা সমাজ ফুলমালা দিয়ে, রেকারিং ডেসিম্যালের মত  বরণ করে নিতেই থাকেন, তখন প্রশ্ন জাগে আমরা কি সত্যিই খাঁটি জিনিষ পেতে আগ্রহী? 

নাকি, আমাদের সামুহিক হতাশা এবং দূর্দশা আজ এতটাই যে 'নাকের বদলে নরুন'পেয়েই আমাদের এই গণ টাক-ডুমা-ডুম  উৎসব সমানে চলিতেছে? 

আবার কখনও এও মনে হয়, আজ আমাদের পাহাড়িয়া সমাজ সেই  'ম্যাড কাও'রোগে আক্রান্ত গরুটি যে নিজের স্বরূপ ভুলেই গেছে এবং তাই তার আর কোন দুশ্চিন্তাও নেই এবং স্বাভাবিকভাবেই সে সব কিছুর উর্দ্ধে এক তুরীয় অবস্থায় পৌঁছে গেছে।

"সুখী, সবাই সুখী, জয় তারা!"  

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~




অনেক কিছুর জন্যই কৃতজ্ঞ, তবে কফির জন্য বিশেষ করে

$
0
0

মাঝেমাঝে রাতে-র ঘুম ভাঙার আগেই আমি জানলার পাশে এসে দাঁড়াই। মনে হয় একটানা অনেকক্ষণ গভীর হবার পর একসময় ফিকে হতে হয় রাতকেও। তখন তার মধ্যে এক প্রশান্ত নীরবতা কাজ করে। কখনোসখনো, সেই নীরবতার মধ্যে এক অদ্ভুত উচ্চতা খুঁজে পাই আমি। তখন তাকে খুব পরিচিত মনে হয়।  মনে হয়, কেবল পাহাড়ের চুড়াতেই, এই উচ্চতাকে অনুভব করেছি আমি। কিন্তু বেলুড়ের গঙ্গার ধারের এই ভাঙা জানলায়, মাঝেমাঝে সেই উচ্চতা নেমে আসে কী করে? মুগ্ধ বিস্ময়ে আমি হতবাক হয়ে যাই। 

আসলে জীবনের প্রতি মুহূর্তে একটা উচ্চতা খুঁজে চলি আমি। একেবারে নাছোড়বান্দার মত। তাই হয়ত একটু বিরক্ত হলেও, সে আমার জানলায় দেখা দিয়ে আবার কোথায় যেন চলে যায় এক অন্যমনস্ক ব্যস্ততায়। এদিকে একটানা কিছুদিন একজায়গায় থাকলেই আমার মন অসম্ভব চঞ্চল হয়ে পড়ে। কারণ আমি জানি এই জীবন আর বেশী দিন নেই। সময় সীমিত, তাই দুচোখ ভরে দেখে নিতে চাই এই পৃথিবী, অজানা পাহাড়-নদী এবং আরও অচেনা তার মানুষকে। বিচক্ষণেরা জানিয়েছেন  এ আমার এক রোগ। সেই বিচক্ষণদের জানাই, কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী  তো সেই কবেই এই ব্যাধির কথা বিস্তারে লিখে গেছেন।  (কবির ডায়াগনোসিসের লিংক এখানে দিয়ে রাখলাম- 'এরিক শিপটনের ব্যাধি'। )

তাই স্বীকার করতে দ্বিধা নেই- আমি অ্যাডভেঞ্চারেই বাঁচি। তাই, এরিক শিপটনের ব্যাধিতেই আমার মুক্তি। 

তবে সব সকালে আমার জানলায় সেই উচ্চতা খুঁজে পাইনা। তখন মগজের রিসেপটর কোষগুলোতে লেপটে শুয়ে থাকা অ্যাডিনোসিনের দলকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরানোর প্রয়োজন হয়। তখন আমি খোঁজ করি এমন একটা অ্যালকালয়েডের, যে আমার রক্তে মিশে যাবে। একই রকম দেখতে বলে, মস্তিষ্কের রিসেপটর কোষগুলো অ্যাডিনোসিন ভেবে হাত মেলাবে তাদের সঙ্গে। ব্যস, ঘুম পাড়ানি অ্যাডিনোসিন গুলোকে সরিয়ে তাদের জায়গা নেবে ক্যাফিন। আমার সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম এবার সজাগ হয়ে উঠবে। নিজের শরীরের সঙ্গে এ এক প্রাত্যহিক প্রবঞ্চনা। অ্যাড্রেনালিন অবশ্য বলবে, যাক বাবা, বাঁচালে! ভাগ্যিস ক্যাফিন ছিল। একা আর কতদিক সামলাব?

থ্যাংক ইউ গড ফর কফি!  



কে-টুতে কাতুকুতু

$
0
0

কে-টুরও কী শেষে এভারেস্টত্ব প্রাপ্তি হল?  কে-টুও মি টু বলল? k2 says 'me too'*? Blimey! 

কে-টু ও বলছে মি টু , ছবি সুত্রঃ ইন্টারনেট 

এভারেস্টে ফি-বছর ট্রাফিক জ্যাম দেখে এখন জনগণ অভ্যস্ত, তাই গত কয়েক বছর কেউ সেরকম 'গেল গেল'রব তোলেন নি। সয়ে গেছে। তাই বলে কে-টুতেও কাতুকুতু? এও দেখতে হল? 

'Savage Mountain'-এও সেই তারকেশ্বরে বাবার মাথায় জল ঢালার মত লাইন দেখে বিদগ্ধজনেরা সেরকমই বলছেন। 

ব্রায়ান হলের পোস্ট সুত্রঃ ফেসবুক 

নিমস দাইয়ের একটি পোস্ট শেয়ার করে ব্রায়ান হল ফেসবুকে লিখেছেন, "I am perplexed, and I am unable to process the importance of this ascent. Only time will put it in historical context. From when I was on K2 in 1986 and again in 2000 I can only see it as a different game to what I took part in. Mountaineering has become a goal orientated pursuit where style and ethics have been discarded by using the maximum resources available particularly for the clients, who totally rely on fixed ropes, oxygen and everything prepared and carried by a team of highly organised guides. Modern weather forecasts are also a game changer. I view it as (perhaps through outdated eyes), like competing in the Tour de France with an electric bike." 


সেলিব্রিটি ক্লাইম্বার নিমস দাজুর সেই ছবি, সুত্রঃ ইন্টারনেট 



লক্ষ লক্ষ ডলারের খেলা ব্রায়ান কাকা। অবাক হবার কী আছে? এমনটা তো হবারই ছিল। ভবিতব্য লেখা হয়েই গিয়েছিল যখন থেকে অ্যাডভেঞ্চার আর পাহাড় চড়াকে পণ্যে পরিণত করা শুরু হয়েছিল। এখন তো কোন এজেন্ট কত পারসেন্ট সামিট সাকসেস দিতে পারল তারই প্রতিযোগিতা চলবে, কে-টুতেও চলবে, পিওরিস্ট পাহাড়িয়াদের ভাল না লাগলেও চলবে- যেমন এতদিন চলছিল নেপাল এবং চীনের অন্যান্য ৮০০০ মিটারের পাহাড়গুলোতে।  

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ল কয়েক বছর আগে ইন্টারনেটে একটা বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম। সেই বিজ্ঞাপনের ছবি এবং ক্যাপশন এখানে দিলাম- দেখুন, বিজ্ঞাপনের লাইন পড়ুন এবং বুঝুন- 

ওপরে বিজ্ঞাপনের ছবি এবং নীচে সেই সেলস পিচ- 

“What's an intrepid adventure traveler to do when they've already visited all seven continents, climbed Kilimanjaro, hiked the Inca Trail, and sailed the Galapagos Islands? Why, visit the North Pole of course!  Not many people realize that it is actually possible to make the journey to the very top of the world, but for those who are adventurous enough – and have plenty of cash..."

কী বুঝলেন কাকা? সব অ্যাডভেঞ্চার করে ফেলেছেন? কিলিমাঞ্জারো, ইনকা ট্রেল, গালাপাগোস দ্বীপ- সব 'করা'হয়ে গেছে? এবার কী করবেন ভাবছেন? কেন? এতে ভাবার কী আছে? চলুন এবার উত্তর মেরুটা মেরে দিয়ে আসি, কেমন? আরে উত্তর মেরু যাওয়া আর এমন কী ব্যাপার? আপনাকে একটু দুঃসাহসী হতে হবে, আর বেশ মোটা ম্যাপের ক্যাশ থাকতে হবে...ব্যস কেল্লা ফতে! 

যাই হোক, ব্রায়ান হলের পোস্টের থ্রেডে অনেকেই মন্তব্য রাখছেন। তবে তার মধ্যে আমার এক পরিচিত জন ইয়ান ওয়ালের কমেন্ট এখানে তুলে দিলাম- 



 

এদিকে আমার প্রিয় আর একজন দুর্ধর্ষ ক্লাইম্বার টিম ম্যাকার্টনি স্নেপ লিখেছেন-



ইস, এমন সত্যি কথা লিখে দিলেন ইয়ান এবং টিম? এখানে এসব লোকে সহ্য করবে না বলে দিলাম! 

যাইহোক, যাঁরা বাপের ভিটে এবং মায়ের গয়না বিক্রি কিংবা জনগণের কাছে ধার করে এজেন্সির প্যাকেজ না কিনলেও অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে পান- তাঁদের জন্য স্বয়ং রেইনহোল্ড মেসনারের পরের কয়েকটা লাইন দেওয়া রইল- 

"Put on your boots and get going. If you've got a companion, take a rope with you and a couple of pitons for your belays, but nothing else. I'm already on my way, ready for anything - even for retreat, if I meet the impossible. I'm not going to be killing any dragons, but if anyone wants to come with me, we'll go to the top together on the routes we can do without branding ourselves murderers." ( Reinhold Messner, Murder of the Impossible) 


আর এই বিষয়ে এই অধমও কয়েক বছর আগে একটা পুরদস্তুর টেড-এক্স টক দিয়ে ফেলেছিল। সেটার লিংকটাও এখানে দিয়ে দিলামঃ 




তাহলে ভেবে দেখুন, আপনার অ্যাডভেঞ্চার কেমন হওয়া উচিৎ? আপনি ঠিক কী চান? মেকি গৌরবের দাম্ভিক হুংকার ? নাকি একটা সহজ, সরল, ওরিজিনাল, অর্থপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার? 


(* I have no intention to trivialise the original connotation of the Me Too movement)

হুইস্কি নিয়ে 'পিট'-পিটানি

$
0
0

পিট (Peat) ব্রিকস বানানোর কাজ চলছে। ছবিঃ findrarewhisky.com

এই লেখার নায়ক 'পিট'এবং গল্পের পটভূমিকা 'হুইস্কি'।  যদি 'পিট'সম্পর্কে আগ্রহী থাকেন তাহলে এই লেখার শেষে কয়েকটা লিংক দেওয়া আছে- সেগুলো পড়ে জানা আরম্ভ করতে পারেন। হুইস্কি না হয় নাই খেলেন- জানতে তো আর বাধা নেই। স্বয়ং মার্ক টোয়েন কী বলেছিলেন মনে আছে তো? সেই যে- “Too much of anything is bad, but too much good whiskey is barely enough.”



আমরা সকলেই আজকের সমাজে লিঙ্গবাদ, বর্ণবাদ এবং অন্যান্য ধরনের বৈষম্য হ্রাস দেখতে চাই। হ্যাঁ চাই। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রত্যহ ঘটে চলা 'ক্যানসেল কালচার'প্রসূত 'মব জাস্টিস'গোছের পদ্ধতিতে চাই কি? একমাত্র সেটাই কি আজকের "হাতে-রইল-পেন্সিল-অস্ত্র' ( পড়তে হবে 'ফেসবুক কিংবা টুইটার')"? 

আমরা জানি, সোশ্যাল মিডিয়া কয়েক মিনিটের মধ্যে এক টুকরো ভিডিওকে 'ভাইরাল'করে দিতে পারে। ঘটনার পিছনে থাকা মৌলিক তথ্যগুলি প্রতিষ্ঠিত হবার আগেই দর্শকরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়ে 'তিনদিনের জেল এবং সাতদিনের ফাঁসি'-র রায় ঘোষণা করে দিতে পারেন।  তার ফলে হারভে ওয়াইনস্টিন গোছের নরকের কীটের পতন যেমন হয়, ঠিক সেরকম বহু নিরীহ লোকের জীবনও বিপর্যস্ত হয়ে যায়।

Mob law is the most forcible expression of an abnormal public opinion; it shows that society is rotten to the core. - Timothy Thomas Fortune

এদিকে হয়েছে কী, বড় বড় কোম্পানি সমাজে ( মানুষের সমাজ এনাদের কাছে বাজার। এখানে নাগরিক থাকেনা- থাকে কেবল ক্রেতা ) তাদের'ইমেজ'ঠিক রাখার জন্য মাঝেমধ্যেই নানারকম প্রগতিশীল, সামাজিক দায়বদ্ধতা, পরিবেশ বান্ধব -  এই ধরণের ট্যাগ লাগানো  কাজে তাঁদের সমর্থন আছে বলে ক্রমাগত ইঙ্গিত দিচ্ছেন। বলাবাহুল্য, এগুলো সবই 'খাচ্ছি- কিন্তু- গিলছি- না'টাইপের ইঙ্গিত। ক্লাইমেট ক্রাইসিস, গ্লোবাল ওয়ার্মিং- এসব ব্যাপারেই সরকারের নীতি নির্ধারণ ঠিক করে দেয়  কর্পোরেট দুনিয়া। জানা গেছে, বিশ্বের বৃহত্তম ১০০ টি শিল্প- সংক্রান্ত কোম্পানিগুলির প্রায় পঞ্চাশ শতাংশই পরিবেশ বান্ধব আইন প্রণয়ন হতে দিতে চায় না।চাইলে এই ব্যাপারে আপনি অনেক তথ্য ইন্টারনেটে পেয়ে যাবেন। তবু একটা লিংক আমি এখানে দিলামঃ মিট দি হিপোক্রিটস  

২০১৫ সালে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি লেখায় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক রস ডাউথার্ট এই ধরণের জাগ্রত বিবেক ধনতন্ত্রকে একটি যুতসই নাম দিয়েছিলেন এবং সেটি হল- '  Woke Capitalism'। বিবেক রামস্বামী ( আর একজন হার্ভার্ড এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক) তো এই বিষয়ে একটা গোটা বইই লিখে ফেলেছেন। বইটির নাম - “Woke, Inc.: Inside Corporate America’s Social Justice Scam.” 

এদিকে বিবিসি জানিয়েছে, স্কটল্যান্ডের হুইস্কি নির্মাতারা নাকি 'পিট'থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।কারণ, 'পিট'পদ্ধতি নাকি 'সাস্টেনেবল'নয়। আবার এও বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্ম নাকি পিট-বিহীন হুইস্কি বানানোর পদ্ধতিকেই বেছে নেবেন এবং স্বাদও মেনে নেবেন।  


আসলে পিটল্যান্ডগুলি একটি অনন্য ইকোসিস্টেম যা জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে এবং কার্বন সিঙ্ক হিসাবে কাজ করে। পিটল্যান্ড খালি করার সময় জমি থেকে প্রচুর পরিমাণে সঞ্চিত কার্বন ডাই অক্সাইড বেরিয়ে যায়, যা গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই, পিট মাইনিং কার্যকরভাবে সাস্টেনেবল নয়,কয়লা বা তেলের মতোই পিটও একটি সীমিত সম্পদ। এটি পুনরুত্থিত হয় ঠিকই, কিন্তু হয় শুধুমাত্র বার্ষিক ১ মিমি হারে। 

পিটল্যান্ড- ছবি সৌজন্য- Global Peatlands Initiative

কিন্তু কথা হল, বিশ্ব ব্যাপী হুইস্কি শিল্প যে পরিমাণ পিটল্যান্ড ব্যবহার করে তা অত্যন্ত নগণ্য। পিটল্যান্ড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যাঞ্জেলা গ্যালেগো-সালা  বিবিসি-র রিপোর্টে  নিজেই বলেছেন- " "Globally, the whisky industry uses a tiny amount of peat ..."তবে আসল সমস্যাটা হল পিট-এর ব্রিক বার করতে গিয়ে গোটা পিটল্যান্ডের জলটাই বার করে দিতে হয়। ফলে, আবার অধ্যাপক গ্যালেগো-সালা বলেছেন, "You affect not just the area of extraction but the whole peatland, you break the ecosystem. You lose the biodiversity, the water cycling, the carbon cycling."


তবু, ধর্মাবতার আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, হুইস্কি নয়, সব থেকে বেশী পিটল্যান্ড ব্যবহার হয় বাড়ি বাড়ি উদ্যানপালনে। ঠিক ধরেছেন, পাড়ায় পাড়ায় যে নার্সারি শিল্প-সেখানে। এই দেখুন বিলেতের এক বিখ্যাত কাগজ কী বলছে- পিট কেন পরিবেশের জন্য খারাপ । আবার ওয়াশিংটন পোস্ট বলছে “5% of human-caused carbon emissions” আসে পিটের ধোঁয়া থেকে (এই যে লিংক )। তবে তার জন্য মুখ্যত দায়ী হর্টিকালচার শিল্প। তাই পিটল্যান্ড বাঁচানো দরকার ঠিকই, কিন্তু প্রথম বলিদান হুইস্কিকে কেন দিতে হবে? 


হুইস্কি উৎপাদনে পিট ব্যবহারের ওপর এমন লঘু পাপে গুরু দণ্ড কেন? দুয়েকটা ছোট ছোট দ্বীপে ( এবং দ্বীপানু) বংশানুক্রমে কিছু মানুষ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে যে পিটেড হুইস্কি বানিয়ে আসছেন তা তো এক কোথায় অনবদ্য শিল্প! অতএব, সবার আগে বাড়ির বাগানে নজর দিন। 


আমার কাছে অবশ্য এই 'হুইস্কিতে-পিটের-ধোঁয়া-দরকার-নেই'ন্যারেটিভটাই একটা ধোঁয়া- একটা 'smokescreen'। নতুন একটা ব্র্যান্ড বাজারে আনার এবং পরিবেশ বান্ধব তকমা লাগিয়ে বেশী দামে বেচার একটি কৌশল। যেমনটা, কেবল হুইস্কি নয়, আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে নিত্যই ঘটে থাকে। 


প্রাত্যহিক সব কেনাবেচাতেই আমাদের, অর্থাৎ ক্রেতাদের বোঝানো হয়, কী সাংঘাতিক ভাল আমার বিক্রেতা। পৃথিবীকে আমার প্রিয় কোম্পানি কিংবা ব্র্যান্ড কতই না ভালবাসেন! বিজ্ঞাপন দেখে মনে হয় যেন পুরো দধীচি লেভেলে এই কোম্পানিগুলোর আত্মত্যাগ। 


 কিন্তু তাঁদের আসল উদ্দেশ্য যে আরও মুনাফা তা তো সর্বজনবিদিত।  

তাই পিট নিয়ে এই সংবাদ মাধ্যমে পিটপিটানি দেখে আমার ভয় একটাই--woke capitalism -এর যা দাপট, তাঁরা চাইলেই যত্রতত্র 'মব জাস্টিস'ঘটাতে পারেন এবং সেই বিজয় উল্লাসে প্রাচীন পিটেড হুইস্কির ট্র্যাডিশনও না 'ক্যান্সেল'হয়ে যায়!  

তবে না, আমি  'war on woke' (WOW) এর দলের কেউ নই । পিটমুগ্ধ এক গুণগ্রাহী মাত্র। 

All you need to know about Peated Whisky

Everything You Need to Know About Peat in Whisky




ইচ্ছে হলে লিখব, না হলে লিখব না! 😆

$
0
0

'পাবলিশ অর পেরিশ-  Publish or Perish' 


ইন্টারনেট বলছে এই কথাটা নাকি ড্যানিয়েল জে বার্নস্টাইন নামের  সাম্প্রতিক সময়ের এক গণিতজ্ঞ বলেছেন। 


তবে আমার ধারণা ছিল কথাটা যথেষ্ট প্রাচীন এবং আমি মনে করি, কেবল তথাকথিত অ্যাকাডেমিয়া নয়, অভিযান সাধনাতেওএই কথা প্রযোজ্য। কারণ অভিযানের যাথার্থ শিক্ষায়, ট্রফি শিকারে নয়। 

(এক্ষেত্রে 'ট্রফি হান্টিং'কথাটা আমি আক্ষরিক কম এবং রূপকার্থে বেশী ব্যবহার করতে চেয়েছি। কারণ, আফ্রিকার কোন এক বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী শিকার এবং মাউন্ট এভারেস্ট আরোহণ- এই দুটিই আজ একই গোত্রে পড়ে গেছে। ) 



আপনি ঠিকই পড়েছেন, লেখার শুরুতেই  আমি 'অভিযান'শব্দটির পর 'সাধনা'শব্দটি ব্যবহার করেছি। কারণ আমি মনে করি, প্রকৃত অভিযাত্রীরা এক একজন সাধক।  গায়ক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের মতই অভিযাত্রীরাও  কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলেছেন।  ফ্রাঁসোয়া আরাগোবলেছিলেন- " To get to know, to discover, to publish- this is the destiny of a scientist."  এবং বিশ্বকবির ভাষায় এই খোঁজ-  "আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না", কারণ- "এই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা।।

হ্যাঁ, অভিযাত্রীরাওকিছু সত্য, কিছু প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে আনেন এবং বিশ্বকে তা জানানোর চেষ্টা করেন।  সেই অনুসন্ধিৎসু 'পথ চলাতেই'তাঁরা 'আনন্দ'খুঁজে পান।  

রিচার্ড ফ্রান্সিস বার্টন, পরবর্তী কালে এরিক শিপটন, ফ্র্যাংক স্মাইথ এবং বিল টিলম্যানদের লেখা কেবল 'চাঁদ উঠেছে-ফুল ফুটেছে'কিংবা 'দুর্গম গিরি- চল জয় করি'নয়; বরং মানুষের সমাজ, বিজ্ঞান, দর্শন এবং আত্ম-জিজ্ঞাসার এক একটি দলিল। 

আমার এও মনে হয়, রিচার্ড বার্টনের (অভিনেতার কথা বলছি না) অভিযাত্রী স্পিরিট এবং কাজ নিয়ে বাংলা ভাষায় একটা কোন কম্প্রিহেন্সিভ কাজ হওয়া উচিৎ।  ওনাদের সময়ে ঔপনিবেশিক 'অ্যাডভান্টেজ এবং প্রিভিলেজ ছিল এবং তাহা অন্যায়'- এই বিচারধারাকে একটু সাইডে সরিয়ে রেখে করলে হয়ত এখনও অনেক কিছু শেখা সম্ভব। তবে অভিযাত্রীদের বিজ্ঞান সাধনা এবং অবদানের নিরিখে আমি ফ্রিৎসফ ন্যানসেন কিংবা  অ্যালেক্সান্ডার ফন হামবোল্টকে অনেক উচ্চ স্থানে রাখি।  এ প্রসঙ্গে একটি অসাধারন বইয়ের কথা উল্লেখ না করে পারা গেল না। বইটির নাম-  Measuring The World, লেখক ড্যানিয়েল কেলমান। পড়ে দেখতে পারেন। অনলাইনে পাওয়া যায়।  আর একটা অসাধারণ ওয়েবসাইটের খবরও আপনাদের দিয়ে রাখি- Explorers Podcast. বিশ্বের সর্বকালের সেরা অভিযাত্রীদের জীবন এবং তাঁদের কাজ এখানে পডকাস্টের আকারে রাখা আছে। বই পড়তে যখন ভাল লাগবে না, তখন চোখ বুজে শুনতে পারেন। ভাল লাগবে।

এই পডকাস্ট গুলো এক একটা ভ্যাক্সিনের মত। কূপমণ্ডূকতার অসুখ ধরবে না।   

( এজেন্সির প্যাকেজে অ্যাডভেঞ্চার কেনা লোকজন এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা এই কথার অর্থ বুঝবেন না।  তবে, ভবিষ্যতে তাঁদের জন্য কোনও আশাও নেই, ভালবাসাও নেই। কারণ আমি বিশ্বাস করি  আমাদের পরের প্রজন্ম প্রকৃত অ্যাডভেঞ্চারকে চিনে  নেবে এবং  তার সঠিক মুল্যায়ন করবে।) 
 
যাইহোক, এবার নিজের ঢাক নিজেই পেটানোতে আসি। 

যে কথা বলতে গিয়ে এতটা ভূমিকা করে ফেললাম তা হল- আমার নিজেরও একটি অভিযান ধারণা এবং সাধনারয়েছে। তার বেশীর ভাগটাই এখনও লেখা হয়নি। হিমালয়ে আমার অভিযান এবং নতুন পথের অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়ে 'দি হিমালয়ান জার্নাল'এবং 'দি আল্পাইন জার্নালে'আমার কয়েকটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছে ঠিকই কিন্তু  বিস্তারিত এবং সর্বাঙ্গীণ ভাবে এখনও লেখা হয়নি। 

আমার আফ্রিকার কাজ এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের পথে চলার কাজ- এই গুলোই আপাতত ছাপা বইহিসেবে প্রকাশিত। 'কাজ'-ই বললাম, কারণ দুবার সাইকেল নিয়ে আফ্রিকার দুপ্রান্তে পাড়ি দেওয়া এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের যাত্রাপথ অনুসরণ করা - এগুলোর কোনটাই কোনও ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ট্যুর ছিলনা। এই প্রত্যেকটা বেরিয়ে পড়াই জন্ম নিয়েছিল ভবঘুরের চরম কৌতূহল থেকে, কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার তাগিদ থেকে। 

'অতএব আফ্রিকা', 'আবার চাঁদের পাহাড়', 'গঙ্গা থেকে চিনশা', 'Sahara Soliloquies'  এবং 'দেশনায়কের পথে'-  আমার যেকোনো একটা বই পড়লেই দেখতে পাবেন এগুলো নিছক ভ্রমণ কাহিনী কম, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং গবেষণালব্ধ প্রবন্ধ অনেক বেশী।  

কোনোদিনই সংবাদ মাধ্যমে প্রচার কিংবা বিশেষ বই প্রকাশ অনুষ্ঠান- এই ধরণের কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। তাই নিজের ব্লগ এবং সোশ্যাল মিডিয়াই আমার সম্বল।  এই মুহুর্তে যেসব বইগুলি অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর ছবি নীচে দিলাম।  বাংলা বইগুলি 'ছাপা বই'।  'Sahara Soliloquies'- Kindle eBook. বইয়ের ছবিগুলিতে ক্লিক করলে কেনার অনলাইন লিংক খোলা উচিৎ। 






পুনশ্চঃ 'সাহারা সলিলোকিস'এবং 'গঙ্গা থেকে চিনশা'-  এই দুটো বইকেই ছাপার ইচ্ছা রয়েছে। সময়, সুযোগ পেলেই হয়ে যাবে। এদিকে পেরুতে আমার অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে 'পেরুস্কোপ'লেখার কাজ শেষ। দেখা যাক কবে প্রকাশ পায় বই হিসেবে। আফটার অল- পাবলিশ, অর পেরিশ বলে কথা। তবে কোন 'প্রেসার'আমার ওপর নেই। 

ইচ্ছে হলে লিখব, না হলে লিখব না! 😆 
আর আপনারাও ইচ্ছে হলে পড়বেন, না হলে পড়বেন না। 

The old man and the bridge

$
0
0

I met an old man by the hanging wire bridge in the vale. 

We were traveling in the same direction, I could tell. 

As I slowed down with a smile, it was just a moment, but there we lived for a while. 

Only the hanging wire bridge knows our tale.

'বাংলার পর্বতারোহণের ঘোলা জলে মাছ ধরা কী যার তার কর্ম?'

$
0
0

গত ২০ আগস্ট, ২০২২, ড্রিম ওয়ান্ডেরলুস্টএবং 'কলকাতা প্রকৃতি পরিব্রাজক সমিতি'র সদস্যগণ- যৌথ উদ্যোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। আলোচনার বিষয় ছিল- 'কোন পথে বাংলার পর্বতারোহণ'।  বিষয় শিরোনামের শেষে জিজ্ঞাসার চিহ্ন, কিংবা বিস্ময় সূচক চিহ্ন- দুটোর কোনটাই না থাকায়  একটা ব্যাপার আঁচ করে নেওয়া যেতে পারে এবং সেটা হল আয়োজকদের মনে পশ্চিমবাংলার পর্বতারোহণের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে একটা সংশয় থাকলেও ( সংশয় নিশ্চয়ই ছিল, তা না হলে খামোখা এরকম একটা সভা ডাকতে যাবেন কেন?), তাঁরা সেটা সদর দরজায় লিখে দিতে চাননি। মানে, একটা মাছ ধরার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু নিজেরা জলে নামতে ( কিংবা ছিপ ফেলতে) তাঁরা রাজী ছিলেন না। সে দ্বায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই ছিল নির্বাচিত বক্তাদের ঘাড়ে। 

নিজেরা চিহ্নিত মাউন্টেনিয়ার না হয়েও, এরকম একটা দুঃসাহসিক উদ্যোগের জন্য আয়োজকদের আমি সাধুবাদ জানাই। একটা কথা স্পষ্ট- আয়োজকদের এই কৌতূহল ( মানে, 'কোন পথে যাচ্ছে ব্যাপারটা'? গোল্লায়? না, কেবলই পারস্পরিক তোল্লায়?)প্রসূত হয়েছে তাঁদের হিমালয় এবং পর্বতারোহণের প্রতি আন্তরিক ভালবাসা থেকে। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না- বাংলার পর্বতারোহণের জলটি ঘোলা এবং সেই ঘোলা জলে মাছ ধরা কী যার তার কর্ম?  বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘোলা জলে পুঁটি কিংবা রুই - এই জাতের মাছই ধরা পড়ে বেশী। কিন্তু বাংলার পর্বতারোহনের ঘোলা জলে যে রাঘব বোয়ালরা ( এবং কিছু মবি-dick, কিংবা মন্টি পাইথনেউল্লিখিত ' Biggus Dickus'  ) চিরকাল দাপিয়ে বেড়ান- তাঁদের ধরা কোনও ক্যাপ্টেন আহাব রূপী আলোচনা সভারই সাধ্য নয়। 

ঘটনাচক্রে, সেই সভায় আমন্ত্রিত বক্তাদের তালিকায় আমার নামও ছিল। ভাবুন কাণ্ড! প্রাথমিক ভাবে, ২০ তারিখ দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর যেহেতু আমার আর কোন কাজ ছিল না তাই ব্যক্তব্য রাখতে রাজী হয়ে গেছিলাম । আমার বিচিত্র কৌতুকবোধকে মাফ করবেন। আসলে আমি বক্তব্য রাখতে রাজী হয়েছিলাম একটাই কারণে-for posterity। 

যে সম্প্রদায় তাঁদের সমস্যাটা কী, সেটা বুঝেও বুঝতে চান না- তাঁরা ভাবের ঘরে চুরি করে থাকেন এবং তাঁদের গুড়ে পুরোটাই বালি। তবুও, আয়োজকদের সম্মানার্থে আমি  খুব সিরিয়াসলি ১৪ মিনিটের একটা 'আর্গুমেন্ট'-ও পেশ করেছিলাম- করেছিলাম পরবর্তী প্রজন্মের কথা ভেবে।  

মনে রাখবেন একটা ১৪ মিনিটের টকে বিষয়বস্তুর চুল চেরা বিশ্লেষণ সম্ভব হয়নি ( আমার দ্বারা হয়নি), তাই খানিক সরলীকরণ থেকেই গেছে। এ বিষয়ে একটা গোটা বই লিখে ফেলা সম্ভব, কিন্তু সে ইচ্ছা আমার মোটেই নেই। তবে আঁতে ঘা যাঁদের লাগার ( জুমারিস্ট, ক্লাবের পেট মোটা কর্মকর্তা, এভারেস্টের সোনার টুকরো ছেলে/মেয়ে) তাঁদের লাগবে। সেটাই উদ্দেশ্য ছিল।  পাণ্ডিত্য ভাল, তবে ক্লাইম্বিং ক্রাফটটা আগে শেখার মত করে শিখুন, একটু একটু করে নিজেদের উন্নত করুন, তারপর নিজের দমে ক্লাইম্ব করুন। এটুকুই বলতে চেয়েছি দাদাগো।  

টুরিস্ট এবং ক্লাইম্বার- একই বৃন্তে দুইটি কুসুম কখনই নয়। হাতি যে কারণে অ্যাসপিরিন নয়- সেই কারণেই নয়। সেটাই এই টকের মোদ্দা কথা।

ঘনিষ্ঠ দুয়েকজনের অনুরোধে আমার সেদিনের বক্তব্য  এই ব্লগে দিলাম। আমার 'আর্গুমেন্ট'কিছু স্লাইড সহযোগে ছিল। সেই স্লাইডগুলি কখনও রূপকার্থে, কখনও আক্ষরিক অর্থে রাখা হয়েছিল। লেখার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সেই স্লাইডগুলিও এখানে দিলাম। প্লেজিয়ারিজমের সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে জেনেও দিলাম।  


(প্রথম কয়েকটা লাইন ছিল আমার সেদিনের পূর্ব-কথন। তারপর, ১, ২ করে স্লাইড অনুসারে ব্যক্তব্য।)  

কোন পথে বাংলার পর্বতারোহণ   -অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায় 

Arguably, এই পশ্চিমবাংলায় পর্বতারোহণের জন্ম পঞ্চাশের দশকে, এই পশ্চিমবাংলা থেকে ষাটের দশকেই All Female Mountaineering Expedition হয়েছিল। তারপর পুরোদস্তুর একটা all-female mountaineering club ও ছিল। এখনও বাংলার মেয়েরা mountaineering করে। তাই আমার মনে হয় আজকের বক্তাদের মধ্যে অন্তঃত ৫০ শতাংশ মহিলা থাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু আজ বক্তাদের মধ্যে একজনও মহিলা পর্বতারোহী নেই। কেন নেই, সেটা নিয়ে ভাবা দরকার, নিজেদেরকে প্রশ্ন করা দরকার বলে আমার মনে হয়। কিন্তু আজ যেহেতু সময় সীমিত- তাই আমাকে নিজের ব্যক্তব্য শুরু করতে হচ্ছে।     


১- দাম্ভিক আত্মপ্রচার মনে হতে পারে, কিন্তু খানিকটা বাধ্য হয়েই নিজের ঢাক পেটানো দিয়ে আরম্ভ করছি। তার কারণ, এখানে উপস্থিত অধিকাংশ মানুষই আমার কাজ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেন না। জানার কথাও না, কারণ আমি স্বনামধন্য কেউ নই এবং বাংলার পর্বতারোহণের পটভূমিকায় নিজেকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ লোক বলে আমি মনে করি না। তবে আজকের আলোচনা সভায় যেহেতু আমি একজন আমন্ত্রিত বক্তা- তাই হযবরল-র শ্রী ব্যাকরণ শিং (বি. . খাদ্যবিশারদ)-এর মত বলতে ইচ্ছে করছে- উপস্থিতবালকবৃন্দস্নেহেরহিজিবিজ্বিজ্‌, আজঅনেকবছরবাদেতোমাদেরসঙ্গেদেখাহয়েবড়ভালোলাগছেএইবছরউৎকৃষ্টখাদ্যগবেষণারকারণেপ্রবাসীহতেহয়েছিলআবারফিরেএসেছি


- জোকস অ্যাপার্ট- আজ থেকে ২১ বছর আগে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম হিমালয়কেই নিজের জীবন করে নেব বলে। ব্যাপারটা খুব ইউটোপিক শোনাচ্ছে তো? কিন্তু এটাই ঘটেছিল। হিমালয় নিয়ে কী করে জীবন কাটাবো? আমার তো বাপের জমিদারি নেই? নায়েব মশাই খাজনা তুলে আনেন না। তবু একদিন সেই ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আসলে হিমালয়ের টান এত ভয়ংকর ছিল যে ঝাঁপ না দিয়ে পারিনি। আর্থিক নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্ক সেই যে শেষ হয়েছিল- আজও তা ঠিক হয়নিকাজ শুরু করেছিলাম ট্রেকিং গাইডের মত করে- দল নিয়ে সন্দকফু-কেদারতাল- এইরকম আর কি! সেদিন এই কলকাতারই কিছু লোকজনকে বলতে শুনেছিলাম- ‘সুজলদার ভাইপো পাহাড় ভালবাসে না- পাহাড় নিয়ে ব্যবসা করে’তবে আজ বলতে দ্বিধা নেই, গত বিশ বছরের জীবনে কবির ভাষায়- “যা দেখেছি যা পেয়েছি/ তুলনা তার নাইভাগ্যিস ঝাঁপ দিয়েছিলাম!



-যেহেতু আজকের বিষয় পর্বতারোহণ কেন্দ্রিক- তাই সাইক্লিং, ব্যাকপ্যাকিং এবং আমার অন্যান্য অ্যাডভেঞ্চারের কথা আজ তুলছি না। গত ২১ বছরে, ভারতীয় হিমালয়ে আমি ৬০টি মাউন্টেনিয়ারিং এক্সপিডিসনে অংশ নিয়েছি- তার ৯০ শতাংশই আমার নিজের planned- organised এবং আমি নিজে সবকটিতে ক্লাইম্বিং লিড করেছি এবং গাইডের কাজ করেছিএগুলো সবই ছিল বিদেশী অভিযান এবং দলের সদস্যরা টুরিস্ট নয়- ক্লাইম্বারবিদেশীদের ক্লাইম্বিং গাইডের কাজ করতে গেলে ক্লাইম্বিংটা সত্যি সত্যি জানতে হয়, সাইড লাইনে বসে বক্তৃতা দিয়ে পার পাওয়া যায় না, শারীরিক সক্ষমতার কথা নাহয় বাদই দিলাম। ক্লাইম্বিং অভিযানের পাশাপাশি আমি অগণিত ট্রেকও লিড করেছি এবং দীর্ঘ ৫ বছর আমি ডগ স্কটের ট্রেক দলগুলির গাইড হিসাবে কাজ করেছি। হ্যাঁ-ঠিকই শুনছেন- ডগ স্কট। উনি আমাকে খুবই স্নেহ এবং ভরসা করতেন।   



৪- হিমালয়ে বেশ কিছু নামকরা পিকে গেলেও বরাবরই আমার আগ্রহ এক্সপ্লোরেটরি অভিযানে বেশীহিমালয়ের বাইরে আমি গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, সুইস এবং ফ্রেঞ্চ আল্পস, উত্তর আমেরিকায় সিয়েরা ক্যাসকেড, কিরগিজস্তান এবং পেরুতে ক্লাইম্ব করেছি। এলব্রুসে স্পিড ক্লাইম্বিং প্রতিযোগিতায় খারাপ ফল করিনি। কেনিয়ায় বিগ ওয়াল ক্লাইম্ব করেছি। কখনও সামিট হয়েছে- কখনও হয়নিতবে বড় মুখ করে এইসব বলার কারণ কী জানেন? এগুলোর কোনটাই কোন ট্রাভেল এজেন্সির প্যাকেজ ছিলনা। সব ক্লাইম্বই ছিল নিজের দমে করা।



৫- হ্যাঁ, নিজের ঢাক পেটানো দিয়ে আমি একটা কথাই বলতে চাইছি- এবং তা হল, আজকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে এই বক্তার একটা সম্যক ধারণা রয়েছে। দু-দশকের কাজের মধ্য দিয়ে আমি অনেক কিছু শিখেছি, গ্রো করেছি এবং একটা ধারণা অর্জন করেছি। ব্যক্তব্যের গোড়াতেই শ্রোতাকে এটুকু জানিয়ে রাখা আমার জরুরী মনে হল। এবার আজকের প্রসঙ্গে আসি।



৬- পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে, ইওরোপ-আমেরিকার পাহাড়িয়াদের আড্ডায়, একটা সম্ভাবনার কথা শোনা যেতশোনা যেত, হিমালয় এবং কারাকোরামের উচ্চতম সবক’টি পাহাড় ক্লাইম্ব হয়ে গেলেই নাকি, পর্বতারোহণের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হবেতখন আর হাল্লা-চলেছে-যুদ্ধের কায়দায় বিশাল আকার-প্রকারের অভিযান সংগঠিত হবে নাতখন কেবল গুটিকয় বন্ধু, অপেক্ষাকৃত ছোট পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবে। নিজেদের দেশের পাথর-বরফে ঘষা খেয়ে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হয়ে চলা নতুন ক্লাইম্বিং পদ্ধতি, শৈলী এবং সরঞ্জামের যথার্থ প্রয়োগের ক্যানভাস খুঁজে বেড়াবে এই নতুন প্রজন্মের পর্বতারোহীরা- হিমালয় এবং কারাকোরাম জুড়েবলা হত, আফটার অল, ক্লাইম্বিং ইস অলসো আ ফর্ম অফ আর্ট এবং আর পাঁচটা আর্ট ফর্মের মতোই পর্বতারোহণও বিবর্তিত, উন্নত, আধুনিক হবে এবং মানুষকে ভাবতে বাধ্য করবে



- ১৯৫৬ সালে, মুজতাঘটাওয়ারে ব্রিটিশ অভিযানের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছিল কারাকোরাম বা হিমালয়ের মতো প্রত্যন্ত পর্বতমালায়, ৭০০০ মিটারের শৃঙ্গে, কলোনিয়াল ঘরানার বাহুল্য বর্জন করেও অতি উচ্চ মানের টেকনিকাল ক্লাইম্বিং কী ভাবে করা যায়ট্রেভর ব্রাহাম লিখেছিলেন, “১৯৭০ সালের অন্নপূর্ণা সাউথ ফেস ক্লাইম্বের থেকেও, সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে ১৯৫৬ সালের এই ক্লাইম্ব প্রকৃত অর্থেই পথপ্রদর্শক ছিল”তার ঠিক পরের বছরই আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ব্রড পিকে। অস্ট্রিয়ার এই দলে ছিলেন মাত্র চারজন ক্লাইম্বার। কোনও শেরপা, হাই-অল্টিচিউড পোর্টার ইত্যাদি ছাড়াই ব্রড পিক ক্লাইম্ব করেই তাঁরা থেমে থাকেননিদল এবার দু’ভাগে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা দু’টি ভিন্ন শৃঙ্গে আরোহণ শুরু করেছিলেন। দু’জন গেছিলেন ৭৪২০ মিটারের এক অনামা শৃঙ্গে, আর অন্য দু’জন চেষ্টা করেছিলেন চোগোলিসা (৭৬৫৪ মিটার) ক্লাইম্ব করারএই দ্বিতীয় দলে ছিলেন হারমান বুল এবং কুর্ট ডিয়েমবার্গার। দুর্ভাগ্যক্রমে এই চোগোলিসাই ছিল প্রবাদপ্রতিম হারমান বুলের শেষ ক্লাইম্ব। কিন্তু, সামিট রিজের কর্নিস ভেঙে বুলের মতো পর্বতারোহীর মৃত্যুর পাশাপাশি যে-স্বপ্নটা বিশ্বের পর্বতারোহীদের মনে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল, তা হল— কয়েকজন বন্ধু মিলে হিমালয়-কারাকোরামের মতো বৃহত্তর পর্বতমালায় গিয়ে তাহলে কেবল একাধিক টেকনিকাল পিকই নয়, আট হাজারি শৃঙ্গও ক্লাইম্ব করা সম্ভব।



৮- এই চালচিত্র থেকে জাম্প-কাট করে যদি চলে আসি ১৯৮১ সালে, নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারির দক্ষিণ দেওয়ালে, তাহলে দেখতে পাব বিদ্যুৎ সরকারের নেতৃত্বে মাইকতোলি সহ মোট তিনটি বাইশ হাজার ফুটের শিখর আরোহণ করছেন গৌতম দত্ত এবং অমূল্য রায়। করছেন কোনও শেরপা কিংবা হাই-অল্টিচিউড পোর্টারের সাহায্য ছাড়াই। দেখতে পাব, রামধনুর দুই প্রান্তের মতোই কারাকোরামে হারমান বুলের জন্ম দেওয়া স্বপ্নের ক্লাইম্বিং ঘরানা এবং দর্শন মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছিল বাংলার এই ক্লাইম্বারদের আইস-অ্যাক্সে ভর করে।



৯-ষাটের দশকের শেষ দিকে এই সম্ভাবনার রশ্মি আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গেও এসে পৌঁছেছিল। ক্লাইম্বিং জগতের হাঁড়ির খবর বাংলার কিছু ক্লাইম্বার তখনই রাখতেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝি থেকে আশির দশক জুড়ে বাংলায় এসেছিল হিমালয়ের ক্যানভাসে অ্যাল্পাইন স্টাইলে পর্বত আরোহণের আর্ট এবং শেরপাদের কাঁধে ভর না করে নিজেদের ক্ষমতায় শিখর আরোহণের প্রচেষ্টা। শিপটন-টিলম্যানের মতো, আটা ভাজা, ছাতু আর পাটালিগুড়ে হিমালয় ডিঙোনোর শক্তি, ’৭০-’৮০র দশকের একঝাঁক বাঙালি ক্লাইম্বাররাও আপন করে নিয়েছিলেন।



১০-অথচ আজ, এই ২০২২-এ দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতেই হয় যে, পর্বতারোহণের আধুনিক ধারায় পা রেখে নতুন অধ্যায়ের সূচনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি--বরং তৈরি হয়েছে একটা কনফিউশন।  কারণ হল,বিগত দুই দশকে জমিতে বেনো জল ঢুকেছে বাঁধভাঙা বন্যার মতোফলে,নবাগতের পদার্পণ এবং যথাসময়ে উত্তরণের মুখ্য দার্শনিক শর্ত এবং তার উদ্দেশ্যের বিশুদ্ধতা- বিষিয়ে গেছে। হিলারি, মেসনার থেকে স্টিফেন ভেনাবলস— এঁরা সকলেই সহমত এই একটা ব্যাপারে। লেট মি এক্সপ্লেন।  



১১- নব্বইয়ের দশক থেকে সেই যে মাউন্ট এভারেস্টের গায়ে ‘ফর সেল’ তকমা লেগেছিল আজ তা এক মহামারীর রূপ নিয়েছে। প্রথমে বাছা বাছা কিছু পাহাড়কে(যেমন কিলিমানজারো, ম্যাটারহর্ন, আকোঙ্কাগুয়া, এলব্রুস এবং মাউন্ট এভারেস্ট)ব্র্যান্ডিং করা হয়েছিল এবং তাদের পণ্য করে ইওরোপ এবং আমেরিকায় একের পর জন্ম নিয়েছিল অ্যাডভেঞ্চার বেচার কোম্পানি— অ্যাডভেঞ্চার কনসালট্যান্টস, মাউন্টেন ম্যাডনেস, জ্যাগেড গ্লোব ইত্যাদিতারপর, কয়েক বছর যেতে না যেতেই জন্ম নিয়েছিল অপেক্ষাকৃত সস্তা দামের (এবং নিম্ন মানের)স্থানীয় কোম্পানিগুলিএভারেস্ট এবং সমগোত্রীয় সব ক’টি শৃঙ্গ পরিণত হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রিতেবলা হয়েছিল, স্বপ্ন সম্ভবের যুগ এসেছে, ফেলো কড়ি চড়ো এভারেস্ট— ব্যস, তুমিও রাতারাতি পরিচিত হবে অভিযাত্রীহিসেবেবলা বাহুল্য, এমন বিজ্ঞাপনে এসেছিল প্রবল সাড়াতারপর সেই খদ্দের ধরে রাখতে, কয়েক বছর পার হতে না হতেই প্রয়োজন হয়েছিল ব্র্যান্ড এক্সটেনশনেরফলে সৃষ্টি হয়েছিলসেভেন সামিটস’, ‘এক্সপ্লোরার্স গ্র্যান্ড স্ল্যামগোছের গালভরা নামের প্যাকেজ ট্যুরপ্রথম দিকে এই সব বিজ্ঞাপনের টার্গেট অডিয়েন্স সীমাবদ্ধ ছিল আর্থিক ভাবে সচ্ছল প্রথম বিশ্বের মানুষজনের মধ্যেএভারেস্টের এমআরপি ৬৫ হাজার ডলার ছুঁয়েছিল



১২- আর এখন বাংলার গ্রামের ছেলে বা মেয়েটি তার মায়ের গয়না, বাপের জমিজমা বন্ধক দিয়ে, যে-কোনও মূল্যে একটা আট হাজারের শিখরে উঠতে চাইছেকারণ, সে দেখতে পাচ্ছে এভারেস্ট বা সমতুল্য কিছু পাহাড়ে একবার উঠতে পারলেই টিভি এবং খবরের কাগজের হেডলাইন হওয়া এ পোড়া দেশে নিশ্চিতমিডিওক্রিটি থেকে মুক্তি পাবার এটা একটা নতুন শর্টকাটপর্বতারোহণের বাণিজ্যিক প্যাকেজিং-এর সাফল্য তাই আজ এক ছোঁয়াচে রোগ এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এই সংক্রমণের জীবাণু ছড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর দ্রুত হারে। দেখতেই পাচ্ছেনপ্যাকেজিং-এর থাবা কে-টুকেও ছাড় দেয়নি।



১৩- সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমবাংলা থেকে আটহাজারি শৃঙ্গ ‘জয়’ করতে যাওয়ার মিছিল তাই কোনও যুগান্তকারী ঘটনা নয়— বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা হয় অযোগ্য, না হয় ট্যুরিস্ট ক্লাইম্বারদের ইগো ট্রিপ। বিগত তিন দশকে বিশ্ব জুড়ে পর্বতারোহণ দর্শনের দৈন্য দেখে ডগ স্কট তো একেবারে রাখঢাক না করেই বলেছেন, “যাদেরই পকেটে টাকা আর মনে ইনস্ট্যান্ট সেলিব্রিটি হবার শখ ছিল তারা তাদের সেই স্বপ্ন কিনতে পেরেছে”



১৪- তবে, বনিংটন-ডগ স্কটরা কী বলছেন এসব বিষয়ে কথা বলা আজ এই দেশ, বিশেষ করে এই রাজ্যে ভস্মে ঘি ঢালার সমতুল্য। মধ্যমেধার নবজাগরণ এবং তার গণ-উদ্‌যাপনের ফলে আজ নাভিশ্বাস উঠেছে পর্বতারোহণের দর্শনেরএদেশে যারা এভারেস্ট, কিংবা সমতুল ঘরানার কোনও পাহাড়ে ওঠেন তাঁরাই রাতারাতি পূজিত হন। সেই পূজা পর্বতারোহণ-মূর্খ কোনও সাংবাদিকের উচ্ছ্বসিত রিপোর্টেই থেমে থাকে না, খোদ সরকার বাহাদুরও এই দিগ্বিজয়ী বীরদের কখনও সম্মানীয় পদ, কখনও গোল্ড মেডেল ইত্যাদিতে ভূষিত করে থাকেন। একবারও ভাবা হয় না যে, এই স্বঘোষিত, দিগ্বিজয়ী অভিযাত্রীরা আসলে শেরপা এবং স্থানীয় ট্রাভেল এজেন্সির অ্যাডভেঞ্চার কেটারিং সার্ভিসের সম্মানীয় ক্রেতা। যুবসমাজকে একবারও ভেবে দেখার সময় দেওয়া হয় না যে, মাউন্টেন ট্যুরিজম এবং মাউন্টেনিয়ারিং— এই দু’টির মধ্যে তফাত আকাশ এবং পাতালেরএকই চিত্রনাট্য পুনরাবৃত্ত হয় ভারতীয় হিমালয়ে- মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবগুলির বাৎসরিক অভিযানেওশেরপারা রুট ওপেন করেন, রোপ ফিক্স করেন- বাবুরা বলেন করেছি। বলেন, ফিক্সড রোপে জুমার লাগানো দেখতে পাচ্ছেন তো কী হয়েছে, আসলে আমরা নিজেরাই ক্লাইম্ব করেছি; জুমার তো প্রপঞ্চময় মায়াসত্যি, কম ঝক্কি পোয়াতে হয় শেরপা ভাইদের! এক্সপিডিশন থেকে ফেরা বাংলার বনিংটনরা তার পর থেকে দূর্গাপুজার ফিতে ছাড়া আর কিছু কাটেন না এবং দেখা দেন আগামীকালের পর্বতারোহণের উপদেষ্টা, এমনকী, নীতিনির্ধারক রূপেসমস্যাটা এখানেই।



১৫- এদিকে বিশ্বের পর্বতারোহণ ম্যাপে যুক্ত হয়েছে নতুন এক শ্রেণিএঁরা নিজেদের মাউন্টেনিয়ার কিংবা অ্যাল্পিনিস্ট নয়, পরিচয় দিচ্ছেন মাউন্টেন অ্যাথলিটহিসেবেএকের পর এক শিখর জুড়ে, তা আল্পসই হোক কিংবা হিমালয়, গত দশ বছরে আমরা স্পিড রেকর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতা দেখছি২০১৩ সালে, লোৎসে ফেসে উয়েলি স্টেক-সিমোনে মোরোদের সঙ্গে শেরপাদের হাতাহাতি-রেষারেষি পৃথিবীর সামনে এক চরম অস্বস্তিকর চিত্র তুলে ধরেছে। ফি বছর আরও বিচিত্র, আরও কঠিন, আরও দ্রুত গতির কিছু চমক জাগানো ক্লাইম্ব করাকে উয়েলি স্টেক বলতেন তাঁর ‘বিজনেস’। এভারেস্টের সেই তিক্ত ঘটনার পর ‘দি নিউ ইয়র্কার’ পত্রিকাকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উয়েলি স্টেক বলেছিলেন, “To make business, you need stories. To create stories, you need to come up with projects—bigger and bigger ones with each passing years—and then you need to succeed at them”



১৬- আমাকে ভুল বুঝবেন না। I respect everything in an athlete- strength, speed etc. আমার সঙ্গে যারা পাহাড়ে গেছেন তাঁরা জানেন ফিটনেসের ব্যাপারে আমি কতটা সিরিয়াস। কিন্তু আজ প্রতিনিয়ত এক-একজন মাউন্টেন অ্যাথলিটেরবিগার অ্যান্ড বিগার-এর পিছনে ছোটা দেখে কখনই ওয়াল্টার বোনাত্তির সেই উক্তি মনে পড়ে না: “What is there, beyond the mountain, if not the man?” ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, আট হাজার মিটারের পাহাড় হোক কিংবা আল্পসের কোনও নর্থ ফেস, খবরে থাকার জন্য এই পর্বতারোহীরা যে-কোনও মাদারি-কা-খেল দেখাতে প্রস্তুত। তাই মাউন্টেন আথলিটদের বলছি- আপনাদের দায়িত্ব অনেক। ব্রুস লি- র কথা মনে রাখবেন।  



১৭-চীনের দিক থেকে কে-টু ক্লাইম্ব করা পোলিশ পর্বতারোহী দারিউস জালুস্কি আমাকে বলেছিলেন, “পাহাড় আমার স্টেডিয়াম নয়, পাহাড় আমার থিয়েটারদারিউসের কথায় আমার মনে পড়েছিল, ১৯৮৫ সালে গাশেরব্রুম-৪ শৃঙ্গের পশ্চিম দেওয়ালে আটকে পড়া আর এক পোলিশ পর্বতারোহী ভয়টেক কুর্তিকার কথাকুর্তিকা এবং রবার্ট শাউয়ার সেবার ওয়েস্ট ফেস ক্লাইম্ব করে ফেলেছিলেন, কিন্তু শিখর তখনও দূরে ছিলকুর্তিকা বুঝতে পেরেছিলেন, আর এগোলে মৃত্যু নিশ্চিততাই দু’জনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন নেমে আসারসামিটে না গেলেও বিশ্বের পর্বতারোহী মহল তাঁদের এই ক্লাইম্বকে অসম্পূর্ণ বলেননিসেই প্রসঙ্গে কুর্তিকা বলেছিলেন, “এর থেকে বোঝা যায়, অ্যাল্পিনিজম আসলে স্পোর্টনয়, এটি একটি আর্টOnly in art does a missing link contribute to the meaning of a piece”(অসম্ভবের সীমারেখায় ছবি আঁকা এই ক্লাইম্বিং রুট দেখে কেউ কেউ একে শতাব্দীর সেরা ক্লাইম্বতকমা দিতে চেয়েছিলেনতার জবাবে কুর্তিকা বলেছিলেন, “কোনও একটি বিশেষ কবিতাকে কি কখনও শতাব্দীর সেরা কবিতা বলা যায়?”)  



১৮- তাই, কুর্তিকা এবং দারিউসের দেখানো দর্শনের ওপর ভরসা রেখে, আজ মনে হয় আবার নতুন করে এক সরল এবং নান্দনিক স্বপ্ন দেখা শুরু করা যায়। ভেবে নেওয়াই যায়, জয়পতাকা ওড়ানোর অভিপ্রায়ে নয়, আবার একদিন বাংলায় সেদিন আসবে যেদিন অভিযান হবে নির্ভেজাল আনন্দের খোঁজে, শেখার আগ্রহে, নিজেকে একজন ক্লাইম্বার হিসেবে গড়ে তোলার হনেস্ট এফর্টে। শর্ট কার্ট দিয়ে নয় 



১৯- মনে রাখবেন আর্টের আগে প্রয়োজন ‘ক্রাফট’। তাই শরীরকে ট্রেন করবেন, নতুন টেকনিক শিখবেন। তারপর, নিজেদের ক্ষমতা, শৈলী এবং অভিজ্ঞতার ওপর ভর করে প্রথমে ছোট ছোট শৃঙ্গ দিয়ে হাত পাকাবেন তাঁরা। তারপর একদিন কেবল গুটিকয় বন্ধু মিলে, পেল্লায় স্যাক কাঁধে তুলে নিয়ে, অপেক্ষাকৃত উঁচু পাহাড়ে, কঠিনতর ক্লাইম্বিং চ্যালেঞ্জের সন্ধানে পাড়ি দেবেনঠিক যেমন ভাবে একদিন ফিনিক্সের মতো, পোলিশ অভিযাত্রীরা তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপের বুক থেকে। পর্বতারোহণ সেদিন হবে আত্মিক উত্তরণের সোপান — আ সেলিব্রেশন অফ লাইফ ইটসেলফ।

সমাপ্ত

চ্যাটারটন মারা গেছেন, চ্যাটারটন আবার মারা যাবেন

$
0
0
দি ডেথ অফ চ্যাটারটন, ১৮৫৬, হেনরি ওয়ালিস 


সারাদিন ধরে আমার ঘরের দেওয়াল, জানলার পাল্লা, 
পায়া-ভাঙা চেয়ার, স্তূপাকৃতি ধুলো-ঢাকা প্রাচীন আসবাব-
সব কিছু দেখি আমি। 

সত্যি, আমাদের সব কিছু পুরোনো, ধুলোপড়া, ভাঙাচোরা। 
তবু একটা ক্লান্ত, মলিন লাবণ্য যেন রয়েছে কোথাও। 
ঠাম্মার আদরের মত,
লেপ্টে রয়েছে সবকিছুর গায়ে।  

একদিন এই ঘরে বাবা-মা থাকত। 

এখন এই ঘরে আমি থাকি। 

আমি চলে যাবার পর হয়ত অন্য কেউ থাকবে। 

তার চোখে এই লাবণ্য দেখা দেবে কী? মলিন হয়েও দেখা দেবে কী? 

অবশ্য, না দিলেই বা কী আসে যায়! 

চ্যাটারটন মারা গেছেন, চ্যাটারটন আবার মারা যাবেন।  


बेवकूफों का आक्रमण

$
0
0


যারা পর্বতারোহণের একটা যুগ দূরের কথা, যোজন দেখেননি তাঁরাই আজকাল কথায় কথায় অমুক ক্লাইম্বটা যুগান্তকারী, তমুকটা ঐতিহাসিক বলে বজ্র নির্ঘোষ আরম্ভ করেছেন। 

সোশ্যাল মিডিয়ায় করেছেন, যেমনটি তাঁরা করেই থাকেন। তাতে কোন সমস্যা ছিল না। কারণ দেখা যায় এই টাইপের নিষ্পাপ নির্বোধদের ঘোষণায় যাঁদের বিশেষ শিহরণ হয় তাঁরা বেশীরভাগই জীবনে এক পিচও ক্লাইম্ব করেননি। এরা সবেতেই হয় উদ্বেলিত উচ্ছ্বাসে হাততালি দেন, নয় ঘৃণার বিষ ছড়িয়ে দেন। এনারা সব কিছুরই বিশেষজ্ঞ, নিজেদের ফোনের এজলাসে এনারা নিজেরাই সাক্ষী, নিজেরাই বিচারপতি। 

কিন্তু আজকাল এরকম ঘোষণায় খবরের কাগজ টিভিও নড়েচড়ে বসেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় যার তার প্রলাপ থেকে খামচা মেরে খবর  বানিয়ে দেবার ব্যাপারটাও আজকাল নর্মাল ব্যাপার-তা সে সেলিব্রিটি গসিপ কিংবা একটা ক্লাইম্ব - যাই হোক না কেন। 

একো সাহেব সঠিক একেবারেই। 

তবে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব যদি ফোনের স্ক্রিনেই সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে ভাল হত। "কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সে হবার যো নেই।" 

অতএব নিজের চরকায় তেল এবং ক্র্যাম্পনে ধার দেওয়াটাই বেস্ট পলিসি। 



 

Prayers, silent prayers, screaming inside your tiny little head

$
0
0

On 4th October, 2022, I was standing below this, not by accident, but by choice. It certainly was not my first close encounter with an ice-fall. And that is precisely why I was afraid. How many times can one squeeze through an ice-fall and come out unscathed? It is a game of Russian roulette baby! It is only a matter of time before it gets you. 

I was belaying Lakpa and he was climbing fast. We were searching for a passage to the higher ground and this seemed to be the only gateway. I was there below this particluar serac probably for 10 mins or may be it was slightly more. But boy it seemed like eternity. 

Suddenly it seemed the seracs around us were collapsing in real time. They were crashing around us like little thunders. I could feel the vibration of the rumbling avalanches on the tiny belay stance of mine. Gosh the stance was littered with debris too. 

What were we doing there? Our morning's boldness was quickly evaporating. Caught red-handed, we were the trespassers in this forever disintegrating theater.  

These towers of ice were shattering when Shipton and Tilman passed through here in 1934. They scared the death out of Ruttledge's party in 1932. Yet on that morning of 4th October, 2022, their little game of manic perpetual disintegration seemed far from being over. 

I suddenly remembered Ruttledge's warning. Tilman's too. And out of the blue I remembered Ian Clough. Seracs collpase and climbers die. It is a fact. 

And then I prayed for our dear lives. "Not here, not now, not like this!"

That is all I could do. Other than trying to climb faster of course. 

Are we ever ready to accept death? We and our perverted will-to-live even while on a death row. 

##################################################################################

Five days after this, when we reached Bageswar, we learnt about the tragedy on Draupadi Ka Danda II. We were shocked, silenced. Incidentally, that was 4th October too. 


Viewing all 89 articles
Browse latest View live